-শুভ্রজিৎ
রায়
“তার
(নারীর) বুদ্ধি, তার সংস্কার, তার আচরণ নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার দ্বারা বহু যুগ থেকে
প্রভাবান্বিত। তার শিক্ষা, তার বিশ্বাস বাহিরের বৃহৎ অভিজ্ঞতার মধ্যে সত্যতা লাভ
করবার সুযোগ পায়নি।”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রবন্ধ নারী
স্থান, কাল
নির্বিশেষে মানবসভ্যতার ধর্মশাস্ত্র ও
সামাজিক বিধি-বিধান, আচার-বিচার , ক্রিয়া-কলাপের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে দেখা
যায় , এই তথাকথিত ধর্ম ও সামাজিক নিয়ম নারীকে ক্রমাগত শোষিত, নির্যাতিত ও
বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তার অন্তরাত্মায় সার্বিক হীনত্বের তত্ত্ব এমনভাবে প্রোথিত করে দিয়েছে যে সে মেনে নিয়েছে
পুরুষের সামাজিক প্রাধান্য। যা হয়তো বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এক বড়
সাফল্য। যদিও নারীর
প্রতি এই শোষণ ও নির্যাতন সর্বক্ষেত্রেই নিরঙ্কুশ ছিল না এবং স্ত্রী মর্যাদা ও
সম্মানের কিছু ক্ষেত্র অবশ্যই ছিল। আর কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কিছু ইঙ্গিত
অবশ্যই পাওয়া যায়। তথাপি মনে প্রশ্ন জাগে , আজকের এই ভোগ্যপণ্য নির্ভর সমাজে প্রকৃতই কি নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের, স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত
হয়েছে? নাকি ধনতান্ত্রিক পুরুষতন্ত্র নারী স্বাধীনতা নামের নতুন মোড়কের আড়ালে
সুচতুরভাবে বঞ্চিত করে চলেছে তাদের মানবাধিকারকে? আসুন আজ আমরা ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংক্ষেপে আলোচনা করবার প্রয়াস করি নারীবঞ্চনার
ইতিহাসকে ,পর্যালোচনা করি বর্তমানে নারীর সামাজিক অবস্থানকে, অনুসন্ধান করি
ভবিষ্যতের দিশা নির্দেশিকার।
প্রাচীন ভারতে নারীঃ
বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে , সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে পৌরাণিক ভারতীয়
সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তা যেমন স্ত্রীলোকের পক্ষে
প্রীতিপ্রদ নয়, তেমনি পুরুষের পক্ষেও প্রীতিপ্রদ নয়। কারণ তৎকালীন সমাজের
নারীভাবনা যেমন বর্তমানের নারীসমাজের কাছে নির্যাতন ও স্বাধীনতাহীনতার প্রতিরূপ,
তেমনি পরিশীলিত পুরুষের কাছেও তা লজ্জা ও বিড়ম্বনা উৎপাদনকারী।
প্রাগার্য ভারতবর্ষের সামাজিক অবস্থা কি
ছিল, মাতৃতান্ত্রিক ছিল কিনা, অথবা কিভাবে তা পিতৃতান্ত্রিকতায় রূপান্তরিত হল সে
সম্বন্ধে আলোচনায় আমরা যাব না , কারণ যে সমাজের আচার-সংস্কারের সুফল বা কুফল আমরা
এখনও ভোগ করে চলেছি; সেই আর্যসভ্যতা ছিল সম্পূর্ণরূপে পুরুষতান্ত্রিক। খ্রিষ্টপূর্ব
১৫ শতকে গোষ্ঠীবদ্ধ, যাযাবর পশুচারী আর্যরা প্রবেশ করবার পর ক্রমান্বয়ে
প্রাগার্যদের পরাভূত করে উত্তর ভারতের বিভিন্ন
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে যাযাবর আর্যগোষ্ঠী কৃষিবিদ্যা আয়ত্ত করে পরিণত হয় কৃষিজীবীতে।সৃষ্টি হয় পরিবার আশ্রিত
কুলবদ্ধ সমাজব্যবস্থা। আর এই সমাজের প্রতিটি পরিবার গড়ে ওঠে একটি পুরুষকে কেন্দ্র
করে। প্রাগার্য সিন্ধুসভ্যতা থেকে বৈদিক
যুগে উত্তরণের কালে এই পরিবারভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় স্বামী হয়ে ওঠে পরিবারের
সর্বময় কর্তা। ক্রমে শুরু হয় নারীর অনিবার্য অবনমন।
বৈদিক যুগে নারীর অবনমনের এই সমাজচিত্র খুঁজে পাওয়া যায় তৎকালীন
সাহিত্যের বিভিন্ন ধর্ম ও শাস্ত্রগ্রন্থে। যে কারনেই নারীর সৃষ্টি হোক না কেন, মনু সংহিতা
বলছে, “প্রজানার্থং স্থিয় সৃষ্ঠা।” অর্থাৎ প্রজননের জন্যই নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর্যসভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে
পুরুষতান্ত্রিকতা বিস্তৃতির আরেকটি প্রধান কারণ হল নিজ বাসস্থান এবং খাদ্যসংগ্রহের
কারণে যুদ্ধপ্রিয় আর্যজাতির যুদ্ধ করাটাও
প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। আর এই যুদ্ধ সফলতা প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন পেশীশক্তিসমৃদ্ধ
প্রচুর পুরুষ। ফলে দেবতার কাছে তাদের পরম প্রার্থিত হয়ে ওঠে পুত্র সন্তান। অথর্ব বেদে বলা আছে, “পুমাংসং পুত্রং জনয়তং
পুমাননু জায়তাম।” – হে নারী, তুমি পুত্রসন্তান উৎপাদন কর, সে উৎপন্ন পুত্রের
পরও পুত্র উৎপাদন কর। মনুর মত শাস্ত্রকার বলছেন, “প্রজনার্থং মহাভাগা পূজার্হা
গৃহদীপ্তয়ঃ” – প্রজননে ক্ষমতার জন্যই
মেয়েরা পূজনীয়া, গৃহের দীপ্তিস্বরূপ। অর্থাৎ
প্রজননে অক্ষম হলে নারী পূজনীয়া-মহনীয়া হতে পারে না। এমনকি নিজের শরীরের ওপর কোনও
অধিকার থাকতে পারে না নারীর। বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, “ নারী যদি পুরুষের
কামনাপূরণে সাড়া না দেয় তবে উপহারসামগ্রী দিয়ে তাকে বশে আনার চেষ্টা করবে, যদি
তাতেও সে সাড়া না দেয় তবে সেই স্ত্রীকে হাত বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে স্ববশে আনবে।” প্রাচীন সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যও বলছে, “ধন বা নিজের দেহের ওপরে
নারীর কোনও অধিকার নেই।” নারীর স্বাতন্ত্র্যও বৈদিক ধর্মে বহুলাংশে খণ্ডিত। মনু
বলছেন, “পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষন্তি যৌবনে
পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।” –স্ত্রীলোককে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী এবং
বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে, স্ত্রীলোক কখনও স্বাতন্ত্র্য লাভের যোগ্য নয়। যদিও
বিখ্যাত পুরাণ গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “স্ত্রীলোকের অস্বাতন্ত্র্য
এখানে তার শারীরিক সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত।”
বৈদিক যুগে পুরুষ ও নারীর সামাজিক
অবস্থানের পার্থক্য কতটা প্রকট ছিল তার অন্যতম প্রমাণ মেলে তৈত্তিরীয় সংহিতায়।
যেখানে বলা আছে, “ নারী যতই ভালো হোক না কেন তবু সে অধম পুরুষের চেয়েও
নিকৃষ্ট।” বেদোত্তর স্মৃতিশাস্ত্র
নারীর জন্য নিষিদ্ধ করে বেদপাঠ। মহাভারতও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে নারীর রাজধর্ম
আলোচনায়। যদিও মহাভারতে অনেকক্ষেত্রে রাজধর্ম আলোচনায় আমরা সক্রিয় দেখেছি সত্যবতী,
কুন্তী বা দ্রৌপদীকে। তবে মহাভারতে বিভিন্ন সময় ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির ইত্যাদির মুখ থেকে
নিঃসৃত হয়েছে নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর বাক্যবন্ধ। অনুশাসন পর্বে ভীষ্ম বলছেন, “কামিনীগণ সৎকুলজাত,
রূপসম্পন্ন ও সধবা হলেও স্বধর্ম পরিত্যাগ করে। তাদের চেয়ে পাপপরায়ণ আর কেউ নেই।” অনেকটা একই রকম উপলব্ধি
যুধিষ্ঠিরেরও। তিনি বলছেন, “উহারা(নারীরা) ক্রিয়া কৌতুক দ্বারা পুরুষদিগকে বিমোহিত করে।
উহাদিগের হস্তগত হইলে প্রায় কোনও পুরুষই পরিত্রাণ লাভ করিতে পারে না।” পুরুষতান্ত্রিক
মানসিকতার উদগ্র রূপ প্রতিবিম্বিত হয় ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরের বার্তায়। প্রাচীন
সংহিতায় নারীকে কল্পনা করা হয়েছে কর্ষণযোগ্য ভূমির সঙ্গে। মনু বলছেন, “নারী ক্ষেত্রস্বরূপা এবং
পুরুষ বীজস্বরূপ।” ভোগের অভিসন্ধির সঙ্গে সঙ্গে পৌরুষেয়তা
প্রতিষ্ঠার এক সফল অভিপ্রায়।
কিন্তু প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীর সম্মান,
মর্যাদা ও স্বাধিকারেরও কিছু ক্ষেত্র অবশ্যই ছিল। যা কিছুটা বিবৃত না করলে আমাদের
আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে বিধবা -বিবাহ আইন
প্রণয়নের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, সেই বিদ্যাসাগরমশাই বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে
লড়েছিলেন পরাশর সংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে। পুত্রসন্তানের প্রতি আগ্রহ বেশি
থাকলেও রামায়ণ-মহাভারতের যুগে কন্যাসন্তানও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলেন না। রামায়ণ-মহাভারতে দেখা যায় সুপ্রতিষ্ঠিত
রাজারা দত্তক কন্যা লাভ করে পরম আনন্দিত ও
উদ্বেলিত। সীতা,কুন্তী, শকুন্তলা, প্রমদ্বরা- এঁরা প্রত্যেকেই পিতা-মাতার পরম
প্রিয় ছিলেন। কন্যাসন্তানরা পিতৃগৃহে
যথেষ্ট সমাদরে লালিত পালিত হতেন এবং পরিণত বয়স লাভ করার পরই তাঁদের পাত্রস্থ করা
হোত। গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা –ইত্যাদি মহাকাব্যের নায়িকারা বিবাহ বন্ধনে
আবদ্ধ হয়েছেন পূর্ণ যৌবনে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর মনোভাবও
অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট ইতিবাচক। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মত প্রাচীন ব্রাহ্মণগ্রন্থে
লিখিত আছে, স্ত্রী হলেন স্বামী পুরুষের সখা-“সখা হ জায়া”।স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সখিত্বের প্রসঙ্গ মহাভারতেও উচ্চারিত হয়েছে বারংবার।
বলেছে, “ভার্যা দৈবকৃতঃ সখা।” – স্ত্রী হলেন পুরুষের ভাগ্য এবং দৈবের মাধ্যমে
প্রাপ্ত সখা। স্ত্রীর সঙ্গে এমন বন্ধুত্বের কথা এসেছে কালিদাসেও – “গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ
প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।” অর্থাৎ গৃহিণী আমার মন্ত্রণা
সচিব, আমার মিত্র আর ললিতকলা শিক্ষায় আমার প্রিয়শিষ্যা। দ্যুতক্রীড়ায় দ্রৌপদীর
লাঞ্ছনার কথা স্মরণে রেখেও বলতে হয় যুধিষ্ঠিরের মত ব্যক্তিত্ব পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস
আরম্ভের পূর্বে কাতর হয়ে বলছেন, আমার মায়ের মত পালনীয়া দ্রৌপদী কি করে অজ্ঞাতবাসে
দিন কাটাবেন বিরাট রাজার গৃহে। আবার জতুগৃহদাহ কাণ্ডের পর পাণ্ডবরা যখন
একচক্রাপূরীতে ব্রাহ্মণের গৃহে কালযাপন করছিলেন, তখন বক রাক্ষসের কাছে
খাদ্যবস্তুরূপে প্রেরিত হবার প্রসঙ্গে নিজের স্ত্রী,পুত্র, কন্যাকে রক্ষার্থে
ব্রাহ্মণের স্বয়ং বকরাক্ষসের কাছে উপস্থিত হবার সিদ্ধান্ত নিতে যাবার পূর্বে
পরিবারের সঙ্গে যে আলোচনা হয়, সেখানেও তাঁর কথার প্রতিটি ছত্রে নিজের স্ত্রী,কন্যা
ও পুত্রের প্রতি অসীম মমত্ব ও ভালবাসা। ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে বলছেন, “নিত্যং মাতৃসমাং মম”- তিনি আমার চিরকালীন মায়ের
মত। যে সমাজে যুধিষ্ঠিরের মত রাজপুরুষ এবং নগরের এক সাধারন ব্রাহ্মণ দুজনেই
স্ত্রীকে মায়ের আসনে বসিয়েছেন সেই সমাজে স্ত্রীর মর্যাদা একদম ছিলনা , এমনটা হতে পারে না। আর নারী
স্বাধীনতার কিছু অবকাশও অবশ্যই ছিল। যেমন মহাভারতে দেবযানী। পরিস্থিতি পর্যালোচনা
করলে দেখা যায়, তাঁর জীবনে যে দুটি প্রেম এসেছিল – কচ ও যযাতি –সেগুলির ক্ষেত্রেও তাঁর
স্বাধীনতা ও প্রশ্রয় ছিল দেখার মত। শকুন্তলা, সত্যবতী, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী –প্রত্যেকেই শ্বশুরালয়ে গিয়েও আপন মতামত নির্দ্বিধায়, কখনও
বা স্বামীর মতের বিরুদ্ধে গিয়েও প্রকাশ করেছেন। রামায়ণে সীতার মত শান্তা নায়িকাও
শেষ পর্বে রামচন্দ্রকে ত্যাগ করে আপন মত প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কিন্তু এই স্ত্রী মর্যাদা অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই সমাজের অভিজাত রমণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মহিলাদের সামাজিক
অবস্থান খুব মর্যাদাকর ছিল না পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। পুরুষ তার পৌরুষেয়তার কারণেই কিভাবে নারীর অমর্যাদা
করে তা উপলব্ধি করে ভীষ্মের জবানিতে মহাভারতকার বলেছেন, “দেখো পুরুষেরা ! নারীকে সম্মান দিতে শেখো , কারণ নারী
সব দিক থেকেই সম্মান পাবার যোগ্য। কিন্তু সম্মান তোমরা দিতে পারো না কারণ – তোমরা ঈর্ষাপরায়ণ অর্থাৎ কোনও ভাবে যদি পুরুষের
চাইতে তাদের মর্যাদা বেশি হয়ে যায়, সেই ভয় তোমাদের আছে।”
নিরপেক্ষভাবে বলা যায়, যে কোনও চলমান
সমাজে ভাল ও মন্দ দুইই একত্রে অবস্থান করে। প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজও তার
ব্যতিক্রম ছিল না। সেখানে নারীর অসম্মান, অমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মর্যাদার
স্থানও ছিল।
ইসলাম ও নারীঃ
হজরত মহম্মদ প্রবর্তিত ইসলাম পৃথিবীর স্বীকৃত ধর্মগুলির মধ্যে কনিষ্ঠতম ধর্ম। ৬৩২
খ্রীস্টাব্দে মহম্মদের জীবনাবসান। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরানে নারীর প্রথম দর্শন
সুরা বাকারায়। সুরা বাকারার সেই আয়াতে বলা আছে, “তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের
শস্যক্ষেত্র, অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে খুশি যেতে পার।” (সুরা বাকারা, ২/২২৩)। প্রাচীন ভারতে যেমন নারীকে
কর্ষণযোগ্য ভূমিখণ্ড বলা হয়েছে, ইসলামেও দেখা যায় তারই প্রতিফলন। বৃহদারণ্যক
উপনিষদের মত কোরানও পুরুষকে দিয়েছে অবাধ্য স্ত্রীকে প্রহারের অধিকার। “স্ত্রীদের মধ্যে যাদের
অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেওনা ও
তাদেরকে প্রহার করো।” (-সুরা নিসা, ৪/৩৪) ।
ইসলামে
কোরানের পরেই হাদীসের স্থান। হাদীস হল কোরানের ব্যাখা(Interpretation) । বোখারী শরীফের হাদিস বলছে, “অকল্যাণ
তিন জিনিসে-নারী, বাসস্থান, পশুতে।” আরো বলছে, “নারী
শয়তানের ফাঁদ।” আর কোরান-হাদীস বলে
পর্দা, অবরোধের আড়ালে রাখতে হবে নারীর দেহ- না হলে শয়তান প্রবেশ করে তার শরীরে।
হিন্দু
ধর্মে যেমন পুরুষের বহুপত্নীকতায় কোনও বাধা নেই, অথচ নারীকে স্থিত হতে হবে
একস্বামিকতায়; ঠিক একই রকমভাবে ইসলামও বলছে, “তবে বিয়ে করবে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের
ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার জনকে।”(-সুরা নিসা, ৪/৩) । তদুপরি চারটি বৈধ স্ত্রী রাখার পরও মুসলমান পুরুষ
তার দাসীদেরও সম্ভোগ করতে পারে। “আমি
তোমার জন্য তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করেছি যাদের তুমি দেনমোহর দিয়েছ ও বৈধ করেছি
তোমার ডানহাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের।”(-সুরা আহজাব, ৩৩/৫০) । এছাড়াও
ইসলামের প্রথম যুগে প্রচলিত ছিল চুক্তি বিবাহ বা মুতা-বিবাহ( Contractual Marriage); যা একদিনের জন্যও হতে পারে। এ
প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামী বিশেষজ্ঞ Imam al-Baydawai বলেছেন, “The purpose of the contractual marriage is the mere
pleasure of intercourse with a woman, and her own enjoyment in what she has
given.” আর কোরানে জান্নাতে পুরুষদের
সম্ভোগের জন্য যে অনন্ত যৌবনা হুরদের কথা বলা হয়েছে সেখানেও প্রতিবিম্বিত হয় নারীর
প্রয়োজনীয়তা মূলত পুরুষের যৌনলালসা পূরণের জন্য।
তবে ইসলাম
ধর্মে নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। কোরান বলছে, “পুরুষ যা অর্জন করে সেটা পুরুষের অংশ এবং নারী যা
অর্জন করে তা নারীর অংশ।” কিন্তু সেখানেও আছে
লিঙ্গভিত্তিক অবিচার। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে ছেলেরা যে পরিমাণ উত্তরাধিকার পাবে,
মেয়েরা মোটের ওপর তার অর্ধেক পাবে। পুত্রসন্তান
না থাকলে স্বামীর সম্পূর্ণ
সম্পত্তি স্ত্রী পাবে না।
বিশ্ব মহাকাব্যে নারীঃ
বিশ্বের
অধিকাংশ মহাকাব্যের মধ্যে যে একটি বিষয়
বারংবার প্রতিফলিত হয়েছে তা হল মর্ত্যের সব অশান্তি, দুঃখ, বিরোধ ও সংঘর্ষের মূল
কারণ নারী। গ্রিক কবি হেসিয়দ তাঁর থিওগনি কাব্যে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী
প্যানডোরার অবতারণা করেন। কিন্তু দেবরাজ
জিউসের নির্দেশে তাঁর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হল প্রবঞ্চণা, সর্বনাশ ও দুর্দশার বিষাক্ত
বীজ, যা বিস্তার লাভ করল পৃথিবীতে। মানুষের জীবনে নেমে এলো দুর্দশার অমানিশা।
হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যে ট্রয় যুদ্ধের মূল কারণ হল হেলেনের রূপ ও স্বামীর প্রতি
বিশ্বাসঘাতকতা।পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেসে সৌন্দর্য্য ও প্রেমের দেবী
ইসতার, তাসসোর জেরুজালেম কাব্যের অসামান্য রূপসী আর্মিদাকে ছলনাময়ী, নিষ্ঠুরা,
কামোন্মত্তা , প্রতিহিংসাপরায়ণা রূপে দেখানো হয়েছে। ওডিসি মহাকাব্যে উচ্ছৃঙ্খল রাজকুমারদের দ্বারা
অদিস্যেয়ুসের প্রাসাদ আক্রান্ত হওয়া ও পেনেলোপের পাণিগ্রহণের জন্য তাঁর ওপর প্রবল
চাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হল রাণি পেনেলোপের রূপ ও প্রশংসনীয় গুণাবলি। ইহুদী
ধর্মগ্রন্থ বাইবেল এবং মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্যে স্বর্গোদ্যান থেকে
বিদায় ও পরবর্তী প্রজন্মের মানবজাতির ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করা
হয়েছে আদিমাতা ঈভকে। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী মহাসমরের অন্যতম প্রধান
কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে দ্রৌপদীকে। রামায়ণে বর্ণিত রাম-রাবণের যুদ্ধ ও লঙ্কার
ধ্বংসের কারণ হল সীতার অসামান্য সৌন্দর্য্য।
পাশ্চাত্যে নারীঃ
প্রাচীন ভারতে মনু বা ইসলামে যেমন
নারীকে কর্ষণভূমির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, ঠিক একই রকমভাবে ইউরোপীয় ধর্মশাস্ত্রেও
বলা হয়েছে, “Your wife is tilth for you , then come to your tilth as you please.” আর এই ক্ষেত্রবীজের উপমা আমরা
দেখতে পাই শেক্সপিয়ারের নাটকেও। যেখানে সুন্দরী ক্লিওপেট্রা সম্পর্কে বলা হয়েছে,
“Royal Wench!
She made great Caeser lay his sword to bed.
He ploughed her, and she cropped......”
এমনকি ফরাসি বিপ্লবের সাড়া জাগানো দার্শনিক রুশো পর্যন্ত
বলেছেন, “Why do you consult their words when it is not their mouths that speak?....
To
win this silent consent is to make use of all the violence permitted in love.
To read it in the eyes, to see it in the ways in spite of the mouths
denial....If he then completes his happiness he is not brutal, he is decent. He
does not insult chasteness; he repects it : he serves it.”
যুক্তিবাদী রুশোর কণ্ঠেও যে
প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মনুর কথা।
তবে নারী
আন্দোলনের পাশ্চাত্যের ভূমিকা কিন্তু বিশেষ ইতিবাচক।প্রথম নারী আন্দোলন হয় ১৭৯২
খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ লেখিকা মেরি উলস্ক্র্যাফটের নেতৃত্বে। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে
নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের জন্য গড়ে ওঠে Women’s Social and
Political Union. নারীর ভোটাধিকার অর্জনে যার
ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতকের ষাটের দশকের শেষের দিকে আমেরিকায় সংঘটিত হয় সাড়া জাগানো নারী
আন্দোলন – Women Liberation Movement. এ ছিল এক চরমপন্থী নারী আন্দোলন।
১৯৭০ নাগাদ এই চরমপন্থী নারী আন্দোলন ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের রমণী সমাজে আলোড়ন
সৃষ্টি করে। ইংল্যাণ্ড, নেদারল্যাণ্ড, জার্মানিতে আন্দোলনের তীব্রতা ছিল মারাত্মক।
ইংল্যাণ্ডের মেয়েরা পুরুষের আইনগত দাসত্ব থেকে মুক্তি চাইল সরকারের কাছ থেকে।
জার্মানির মেয়েরা বলল, আমরা স্বতন্ত্র সত্তা। জার্মানির রাস্তায় মিছিল করে তারা
স্বেছা-গর্ভপাতের জন্য আইন চাইল। আয়ারল্যাণ্ডে মেয়েরা বেলফাস্ট থেকে আসা ট্রেন
ডাবলিনের স্টেশনে ঢোকামাত্র আবগারি কর্মীদের ওপর জন্মনিরোধক কন্ডোম, পিল, লুপ
ইত্যাদি ছুঁড়ে ফেলতে আরম্ভ করল। স্লোগান দিল- মেয়েরা শুধু সন্তানধারনের
যন্ত্রমাত্র, আর কিছু নয়।
তবে
নারীমুক্তি আন্দোলনের এই তীব্রতা কালক্রমে কমে আসে। আন্দোলনের ভঙ্গিও পরিবর্তিত
হয়েছে এবং তা রূপ নিয়েছে এক সুসংগঠিত জাগরণের মধ্যে। ফলশ্রুতি হিসেবে এক স্থায়ী
সচেতনতা তৈরী হয়েছে সমগ্র নারী-সমাজের মধ্যে।
শেষের কথাঃ
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়
নারীর জীবনের অধিকাংশ সময়টাই অতিবাহিত হয়েছে শিশুপালন আর ঘরসংসার দেখার কাজে হাজার
বছর ধরে। সহজভাবে বলা যায় নারীর একটা মাতৃত্বের প্রতিমূর্তি প্রাচীন সংস্কৃতি গড়ে
তুলেছে। অন্যদিকে সভ্যতার উন্মেষলগ্নে বন্যপশু শিকার ও তারপর এক জাতিগোষ্ঠির সঙ্গে
অন্য জাতিগোষ্ঠীর লড়াই যুদ্ধের কারণে পুরুষের অভ্যস্ত সংস্কৃতি হয়ে ওঠে যোদ্ধা ও
প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতি। আর সেই সংস্কৃতি দিয়ে নিশ্চয়ই শিশুপালনের কাজটা
সুষ্ঠুভাবে হয় না। মানব সংস্কৃতির নির্মাণও সেইভাবেই। একে কিন্তু পুরুষের ষড়যন্ত্র
বললে অর্ধসত্য উদ্ঘাটিত হবে মাত্র।
আধুনিক সমাজ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
ও দুর্বল আত্মীয়তাবোধে জীর্ণ কর্মক্ষেত্রে
বিগত কয়েক দশকে ; বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে নারীরা বহুসংখ্যায়
প্রবেশ করেছে। কর্মক্ষেত্রের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুরুষের অভ্যস্ত সংস্কৃতির সঙ্গে
সামঞ্জস্যপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রের
প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংস্কৃতি এখন নারীও গ্রহণ করতে চাইছে। নাহলে পুরুষের সঙ্গে
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ নারীর সাম্যের আন্দোলনের অনেকাংশই
পুরুষ সংস্কৃতির অনুকরণ। মূল যুক্তি হল পুরুষ যা পাচ্ছে নারী তা পাবে না কেন?
অর্থাৎ চাই সাম্য।
সাম্যের দাবি অবশ্যই শ্রদ্ধেয়। তা
কর্মক্ষেত্রেই হোক বা যৌনজীবনে। মনে রাখা প্রয়োজন নারীর শুধু দুর্বলতা নয়, শক্তিও
আছে। যা কিছুটা প্রকৃতিপ্রদত্ত, কিছুটা সংস্কৃতি থেকে প্রাপ্ত। তাকে উপেক্ষা করে
পুরুষের সমান হতে চাইলে নারীর পূর্ণমূল্য হবে না, সমাজের মুক্তির পথও হয়ে উঠবে
দুর্গম। নারীর সংস্কৃতিতে এমন অনেক কিছু আছে যা সভ্যতা রক্ষায় সবিশেষ প্রয়োজনীয়।
নারীকে কিছুটা পুরুষের মত হতে হবে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে যেটা ভীষণ জরুরি তা হল
পুরুষকেও কিছুটা নারী সংস্কৃতির প্রভাবে আনা। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যে আছে
অর্ধনারীশ্বরের কল্পনা। এক গভীর সত্য নিহিত রয়েছে এই কল্পনায়। যুদ্ধ বিক্ষোভে
দীর্ণ, ধর্মসন্ত্রাসে বিপর্যস্ত, পরিবেশ দূষণের বিষবাষ্পে দূষিত সভ্যতার এই সংকট
থেকে যদি মুক্তিলাভ করতে হয় তবে প্রয়োজন নারী ও পুরুষের সমন্বয়। সেই সমন্বয়ের
আন্দোলন না হবে নারীতান্ত্রিক, না পুরুষতান্ত্রিক। তা হবে যুগ্মতান্ত্রিক,
মানবতান্ত্রিক। সমাজ ও সভ্যতাকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে আমাদের উপলব্ধি করতে
হবে বিশ্ব সংসারের অভিন্নতা। যে রাজনীতি ও রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা যুদ্ধকে আশ্রয় করে
পালিত ও বর্ধিত , সেখানে যুদ্ধে অভ্যস্ত পুরুষের প্রাধান্য ছিল ঐতিহ্যগত। কিন্তু
বর্তমান সভ্যতার সংকট মোচন করবার জন্য আগামী কয়েক দশকে প্রয়োজন অর্থনীতি ও সমাজনীতির অন্য এক সহৃদয় আদর্শকে
হৃদয়ে ধারণের সদিচ্ছা। আর সেখানে নারীর সবিশেষ ভূমিকার কথা সকলেরই মান্য। তাই সমাজ
ও সভ্যতার স্বার্থে নারী ও পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে গিয়ে একসঙ্গে চলতে হবে
হাত ধরাধরি করে। আর সেটাই হবে সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধারের পথ ও প্রেরণা।
__________________সমাপ্ত__________________
ঋণস্বীকারঃ
1.
Sanders, Andrew -The
short Oxford history of English literature,Oxford University Press, Third Edition.
2.
ভট্টাচার্য, সুকুমারী–
প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ ও ২, গাংচিল, কলকাতা ২০১৪।
3.
দত্ত, অম্লান - প্রবন্ধ সংগ্রহ ২, আনন্দ
পাবলিশার্স, কলকাতা ২০১১।
4. ভাদুড়ী,
নৃসিংহ প্রসাদ – রমণী, কারিগর, কলকাতা ২০১৪।
5. মিত্র,
বীরেশ্বর – বিশ্ব মহাকাব্য প্রসঙ্গ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
২০১৫।
6. সিংহ,
কঙ্কর – ধর্ম ও নারী প্রাচীন ভারত, র্যাডিক্যাল
ইম্প্রেসন, কলকাতা ২০০৯।
7. সিংহ,
কঙ্কর – ইসলাম ও নারী, র্যাডিক্যাল ইম্প্রেসন, কলকাতা
২০১৫।
8. সিংহ,
কঙ্কর – ইসলাম ও কোরান, র্যাডিক্যাল ইম্প্রেসন, কলকাতা
২০১০।