অর্জুন
উলূপী সংবাদ
-শুভ্রজিৎরায়
মহাভারত
মহাকাব্য এক অপরিমেয় রত্নসাগর। এই মহাকাব্যের প্রতিটি চরিত্রই আপন আপন বৈশিষ্টে, নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।প্রধান প্রধান চরিত্রের
পাশাপাশি কিছুকিছু অপ্রধান চরিত্রও মহাকাব্যের বহুব্যাপ্ত মহাকাব্যিক কাহিনীকে আরো
বেশীমাত্রায় প্রকট করতে সহায়তা করে। প্রধান অপ্রধান নির্বিশেষে প্রতিটি মহাকাব্যিক
চরিত্রেরই কিন্তু একটা Focal Point (ফোক্যাল পয়েন্ট)আছে। সেটা আত্মত্যাগ হতে পারে, যশোপ্রার্থণা হতে পারে, আজীবন ধর্মর প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাশীলতা হতে পারে, সংকীর্ণ স্নেহান্ধতা হতে পারে, আবার তা হতে পারে সর্বস্ব নিয়োজিত প্রেম।
শেষোক্ত
যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখিত হল তার ওপর ভিত্তি করেই আজ মহাভারতের এক
অপ্রধান উপেক্ষিতা কিন্তু নিজস্ব ব্যক্তিত্ত্বে ভাস্বর এক নারী চরিত্র বিশ্লেষণে
আমার অতি সীমিত লেখনীশক্তি নিয়ে প্রয়াসী হয়েছি।
কিছুদিন
আগে যখন Shakespeare
র Hamlet পড়ি তখন একটা লাইন ভীষণভাবে মনকে নাড়া দিয়েছিল।
লাইনটা ছিল “Frailty, thy name is woman!” ( ফ্রেইলটি দাই নেম ইজ ওম্যান)। মনে হয়েছিল এ এক
অতিমাত্রায় সাধারনীকরন; নারীজাতির
প্রেমের গভীরতাকে লঘু করার উদ্দেশ্যে এক পৌ্রুষেয় আক্রোশ। তখনই স্থির করেছিলাম
মহাভারতের উলূপীকে নিয়ে লিখব। আমার সীমিত
লেখনীশক্তির মাধ্যমেই চেষ্টা করব উলূপীর প্রেমের গভীরতা বোঝাবার। আসুন আমরা একসাথে
বোঝার প্রয়াস করি উলূপীকে, তাঁর
প্রেমের গভীরতাকে।
দ্রৌপদীর
সাথে পঞ্চপাণ্ডবের পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হবার পর মহামুনি নারদের পরামর্শ অনুসা্রে
নিয়ম স্থির হয়, দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের এক একজনের
গৃহে একটি বৎসর করে বাস করবেন। কিন্তু এসময় অন্য কোনো পাণ্ডবভ্রাতা যদি এসে দেখা
করেন তবে তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে দ্বাদশবৎসর বনবাসীর জীবন অতিবাহিত করতে হবে।অথচ নিয়ম
বন্ধনের অল্পকাল পরেই দৈবের পরিহাসে এই নিয়ম লঙ্ঘিত হয়। লঙ্ঘন করেন তৃ্তীয় পাণ্ডব
অর্জুন। পরিস্থিতির সাপেক্ষে নিয়ম লঙ্ঘন করতে বাধ্য হন ফাল্গুনী।দস্যুদের বিতাড়িত
করবার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণদের গোধন রক্ষার্থে অস্ত্রাগারে প্রবেশ করতে বাধ্য হন
অর্জুন।অথচ সেসময় আয়ুধাগারে বাস করছিলেন দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠির। দস্যুবিনাশ ও
ব্রাহ্মণদের গোসম্পদ পুনরুদ্ধার করবার পর তাই নিয়মানুসারে দ্বাদশবৎসরের জন্য
নির্বাসনে গেলেন পার্থ। পুরবাসী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা সঙ্গী হলেন ফাল্গুনীর এই
অনির্দেশ্য বনবাসযাত্রার।
বহু
তীর্থ, বহু প্রদেশ অতিক্রম করে অর্জুন
উপস্থিত হলেন গঙ্গাদ্বারে। যা আজ হরিদ্বার নামে সুপ্রসিদ্ধ। গঙ্গা ভাগীরথীর
অসামান্য প্রাকৃতিক শোভা দেখে পুলকিত হয়ে উঠলেন ফাল্গুনী। তিনি এতটাই প্রভাবিত
হলেন গঙ্গাদ্বারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে যে, সেখানে কিছুদিন বাস করবার জন্য নির্মান করে ফেললেন একটি আশ্রম।
মন্ত্রোচ্চারন করে ব্রাহ্মণরা যজ্ঞ শুরু করলেন আশ্রমে। জ্বলে উঠল যজ্ঞের আগুন। হয়ে
চলল হোম আর পুষ্পাহুতি। পবিত্র যজ্ঞের অগ্নি আলোকে দৃষ্টিগোচর হল গঙ্গার অপর
তটভূমি থেকেও।
কোনো
এক পুণ্যপ্রভাতে স্নানের সময় ধনঞ্জয় নামলেন গঙ্গায়। স্নিগ্ধ, সুস্নাত হলেন গঙ্গার শীতল জলে। সমাপন করলেন
পিতৃলোকের তর্পন। তর্পন সমাপনের পর অর্জুন প্রয়াসী হলেন জল থেকে উঠবার; আশ্রমে বসে অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠান করবার উদ্দেশ্যে।
ঠিক সেই সময়েই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। নাগকন্যা উলূপী এসে অর্জুনকে নিয়ে চলে
গেলেন জলের গভীরে অন্য কোনো এক স্থানে। যেন অনেকটা মৎস্যকন্যা বা জলপরীর মত।
অর্জুনকে নিয়ে উলূপী উপস্থিত হলেন নাগরাজ কৌরব্যের রাজগৃহে। অর্জুন এসে দেখলেন
সেখানে হোমকার্য্য সমাধার জন্য প্রজ্জ্বলিত রয়েছে অগ্নি। শান্ত ও সমাহিত চিত্তে সেই পবিত্র অগ্নির সামনে হোমকার্য্য সমাপন করলেন
অর্জুন।
এক্ষেত্রে
একটা বিষয় লক্ষ্য করবার মত।উলূপী সহসা অর্জুনকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন কোনো নাগলোকে
আর অর্জুনও কোনো বাধা দেবার প্রয়াস করলেন না। অর্থাৎ উলূপী যেমন প্রথম দর্শনেই
মোহিত হয়েছিলেন অর্জুনকে দেখে; ঠিক
একইভাবে অর্জুনেরও কোনোরকম আপত্তি ছিলনা উলূপীর সঙ্গলাভে। নাগসুন্দরীর আকর্ষণে
তিনিও চললেন জলের গভীরে এক সংবেশিত আচ্ছন্নতায়।
অগ্নিহোত্র
কার্য্য সমাধা হবার পর অনেকটা যেন স্থিতধী হলেন ফাল্গুনী। বাস্তববোধে অনুধাবন
করলেন এই সুন্দরী কন্যা নিশ্চয়ই তাঁকে অগ্নিহোত্র কার্য্য সুসমাধানের জন্য এখানে
নিয়ে আসেনি। হয়তো বা সম্যকভাবে বুঝতেও পেরেহিলেন তাঁর প্রতি উলূপীর এই দূর্নিবার
আকর্ষণ।তাই স্মিতহাস্যে উলূপীকে জিজ্ঞাসা করলেন, সহসা এমন অসমসাহসের একটা কাজ করলে কেন সুন্দরী?এই সুন্দর দেশটিই বা কার ?আর
তুমিই বা কে? কি তোমার বংশপরিচয়?একসাথে বেশকিছু প্রশ্নের অবতারনা করলেন ফাল্গুনী।
উলূপী উত্তর দিলেন,
আমি নাগকন্যা। প্রসিদ্ধ
ঐরাবৎ বংশে জন্মেছেন আমার পিতা কৌরব্য। তাঁরই দুহিতা আমি উলূপী।খুব স্পষ্টভাবে
অর্জুনকে নিজের ও নিজের বংশপরিচয় জানালেন উলূপী। আরো বললেন, তুমি যখন গঙ্গাস্নান করছিলে, তখনই তোমাকে দেখে সম্মোহিত হয়েছি আমি, সম্পূর্ণ প্রণয়াসক্ত হয়েছি তোমার প্রতি। তোমাকে
পাবার জন্য আমার দেহ ও মন দুইই ব্যাকুল হয়ে রয়েছে।
এখানে
একটি বিষয়ে দৃকপাত করা প্রয়োজন। অর্জুনের হোমকার্য্য সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব
পর্য্যন্ত রীতিমতো আর্যোজনোচিত আচরন করেহেন উলূপী। নাগরাজ্যে নিয়ে এলেও প্রথমেই
তিনি অর্জুনকে নিয়ে এসেছেন অগ্নিশরণগৃহে। যেখানে নিজের অভিপ্রেত অগ্নিহোত্রকার্য্য
যথোচিতভাবে সমাধা করতে সক্ষম হন ধনঞ্জয়। কিন্তু হোমকার্য্য সমাধা হবার পর যখন
অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন তাঁকে সহসা এই নাগলোকে আনার অভিপ্রায়; তখন নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে কুন্ঠিত হননি উলূপী।
স্পষ্ট ও দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন তিনি অর্জুনের প্রতি আসক্ত। একে অনেকে হয়ত
ব্যাখা করতে পারেন যে,
নাগরিক
শালীনতাবোধের অভাব উলূপীর মধ্যে।কিন্তু এটাকে বরং এভাবে দেখা সমিচীন যে , উলূপী মনে করেন নিজস্ব মনোভাব, মনোভিলাষ গোপন করা এক ধরনের কৃত্রিমতা ও
মিথ্যাচার। আর সে যুগে পুরুষনারী নির্বিশেষে যাকে লাভ করবার ঈপ্সা হত অকপটভাবে তা
স্বীকার করতে লজ্জা বা কুন্ঠা হত না। তাই স্নানরত ফাল্গুনীর অনিন্দ্যসুন্দর সুগঠিত
শ্যামবর্ণ অনাবৃত বলিষ্ঠ দেহকান্তির দিকে দৃষ্টি পড়ে যে সম্পূর্ন বিমোহিত হয়েছিলেন
উলূপী – তা অকপটভাবে স্বীকার করতে
দ্বিধা করেননি এই নাগসুন্দরী।সুস্পষ্টভাবে অর্জুনকে জানিয়েছেন, তোমাকে পাবার জন্য আমার দেহমন জর্জরিত। অতএব
তোমারও কর্তব্য আমার কাছে নিজেকে সমর্পন করা। আর তাছাড়া আমার তো স্বামীও নেই, যার কাছে আমি আত্মনিবেদন করতে পারি।তাই আমাকে নিয়ে
তোমার দ্বন্দ্বের কোনো কারন নেই। এসো, আজই কোনো নির্জনস্থানে আত্মসর্পন করে আনন্দিত কর আমায় - “ অনন্যাং নন্দয়স্বাদ্য প্রদানেনাত্মনো রহঃ।”
উলূপীর
কথাবার্তা এটা ভীষণ রকমভাবে স্পষ্ট যে, অর্জুনের কাছে সর্বস্ব নিবেদনের জন্য এই নাগকন্যার সমগ্র সত্তা তীব্ররকম
উৎসুক। আর হয়তো অর্জুনকে একান্ত নিজের করে পাবার সুতীব্র ঈপ্সা তার বক্তব্যে সামান্য
অপলাপ সৃষ্টি করেছে। উলূপী অর্জুনকে বলেছেন, আমার তো স্বামীও নেই, যিনি
আমার সত্তার অধিকারী,
অতএব আমাকে তুমি
নির্দ্বিধায় গ্রহন কর। অর্থাৎ এখানে উলূপী অর্জুনকে সোজাসুজি এখনো জানাননি যে তিনি
বিধবা রমনী। অথচ উলূপীর যে পূর্বে বিবাহ হয়েছিল তার উল্লেখ মহাভারতেই আছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন উলূপীর পুত্র ইরাবান সমরাঙ্গনে অবতীর্ন হন তখন ইরাবানের
পরিচয় প্রসঙ্গে মহাভারতে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে জানান, ইরাবান নাগরাজ ঐরাবত দুহিতার গর্ভজাত অর্জুনের পুত্র। প্রসঙ্গক্রমে
মহাভারতে আরও কথিত আছে এই নাগকন্যার পূর্বেই একবার বিবাহ হয়েছিল এক নাগ
সম্প্রদায়ের পুরুষের সঙ্গে। সুন্দরী কন্যা নিজ সম্প্রদায়ের যোগ্য পাত্রের হাতে
সমর্পন করেন উলূপীর পিতা ঐরাবত কৌরব্য। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে উলূপীর স্বামী নিহত
হন পক্ষিরাজ গরুড়ের হাতে।
মহাভারত
ও পুরাণ এর আখ্যান অনুযায়ী সর্প ও গরুড়
পরস্পরের চিরশত্রু। বাস্তবতার নিরিখে যদি আমরা এটাকে বিচার করি তাহলে এভাবে ব্যাখা
করা যায়, গরুড় ও সর্পগোষ্ঠীর মধ্যে
চিরন্তন এক বৈরীতা ছিল। এই বৈরীতার সূত্রেই কখনো হয়ত উলূপীর স্বামী গরুড় অথবা সেই
গোষ্ঠীর কারো হাতে মৃত্যুবরন করেন।
বিবাহের
খুব অল্পদিন পরেই কপাল পুড়ল উলূপীর। অকালে হারালেন নিজের স্বামীকে। পিতৃগৃহেই
পালিত হতে থাকলেন উলূপী। জীবনে নেমে এল অমাবস্যার নিকষ অন্ধকার। কোনো সন্তানও না
থাকবার কারনে এই নিরস জীবন অতিবাহিত করবার মত কোনো অবলম্বনও ছিল না তাঁর।পিতা
কৌরব্যও তাঁর কন্যার এমন বেদনাদায়ক জীবন দেখে মনে মনে পরম ব্যথিত। বিয়ের এত অল্প
সময় পরেই স্বামীহারা হতে হল তাঁর এই পরমাসুন্দরী কন্যাকে।
কিন্তু
সময়ের সাথে সাথে মানুষের মনের রাগ , দুঃখ,ঘৃণা, যন্ত্রনা ধীরে ধীরে নিবৃত্ত হয়ে আসে। উলূপীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল
না। ধীরে ধীরে তিনিও ভুললেন স্বামীর কথা। অথচ উলূপীর তো বয়স বেশি নয়। তাই অন্তরের
গভীরে কামনার বহ্নি প্রশমিত হয়নি তখনো। সচেতনে হোক আর অবচেতনে হোক তিনি নিশ্চয়ই
অনুসন্ধান করছিলেন এমন এক পুরুষের যার সঙ্গলাভে তিনি তৃপ্ত হতে পারেন। তাই যখন
তিনি দেখতে পেয়েছেন গঙ্গাস্নানরত ফাল্গুনীকে- মোহিত হয়ে পড়েছেন তাঁকে দেখে। নিঃসঙ্কোচে
আত্মনিবেদন করতে চেয়েছেন অর্জুনের কাছে।
কিন্তু
পৃথানন্দন অর্জুন নাগরিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত, অভিজাত, রুচিস্মপন্ন। আর্য্য
ক্ষত্রিয়লোহু প্রবাহিত তাঁর শরীরে।তাই শালীনতাবোধে, বীরোচিত ভব্যতায় বা ‘শিভ্যালরি’(Chivalry)র কারনে উলূপীর সাথে প্রাথমিক
পরিচয়পর্বে খুব সামান্যই বার্তালাপ করেছেন অর্জুন। তবে এটাও খুব পরিস্কারভাবে
প্রতীয়মান যে অর্জুনও উলূপীর প্রতি যথেষ্টমাত্রায় আকৃষ্ট। কারন উলূপী যখন অর্জুনকে
নিয়ে চলছিলেন জলের গভীরে কৌরব্যনাগের আবাসে সেসময় অর্জুনের মধ্যে সামান্য প্রয়াসও
লক্ষ্য করা যায় না উলূপীর বাহুবেষ্টনী থেকে মুক্ত হবার। বরং উলূপীর টানে
নির্বিবাদে এসেছেন তিনি নাগলোকে।
উলূপীর
এই তন্ময়ীভবন, অর্জুনকে পাবার ব্যাকুলতা, সর্বস্ব নিবেদনের আর্তি পুরুষোত্তম
পাণ্ডবকুলভূষণ মহাবীর অর্জুনকেও চুম্বকের মতই আকর্ষণ করেছিল। স্বয়মাগতা এই
নাগসুন্দরীকে প্রত্যাখান করবার অভিপ্রায় অর্জুনের ছিলনা অথচ প্রধান প্রতিবন্ধকতা
হয়ে দাঁড়াল পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা।নারদের সম্মুখে পঞ্চপাণ্ডব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন – দ্রৌপদীর সাথে কোনো পাণ্ডবভ্রাতা একগৃহে বাস করবার
সময় যদি অন্য কোনো পাণ্ডবভ্রাতা সেই গৃহে প্রবেশ করেন তবে তাঁর জন্য নির্ধারিত
থাকবে দ্বাদশবৎসর বনবাস আর সেইসঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন অর্থাৎ স্ত্রীসঙ্গবর্জন। তাই
অর্জুন একদিকে যেমন উলূপীকে প্রত্যাখানও করতে পারছেন না অন্যদিকে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের
কারনে গ্রহনও করতে পারছেন না। এমন উভয়সংকটে অর্জুন পরিস্থিতি বিচারের দায়ভার অর্পন
করলেন উলূপীর হাতেই। স্বয়ম্বরসভায় মৎস্যচক্ষুভেদ করে, সমবেত রাজন্যবর্গকে যুদ্ধে
পরান্মুখ করে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে জয় করেও না পাবার বেদনা, তদুপরী বনবাসীর
ব্রহ্মচর্য জীবন – ভীষণ
হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল অর্জুনকে।তাই এই নাগকন্যার প্রগলভতা, নিঃসঙ্কোচ
আত্মসমর্পন ভালো লেগেছে অর্জুনেরও।
অর্জুন
বললেন, কল্যানী আমি দ্বাদশবর্ষের জন্য ব্রহ্মচর্যপালনের প্রতিজ্ঞা করে দেশভ্রমনে
ব্রতী হয়েছি।ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সর্বসমক্ষে স্থির করেছেন এই নিয়ম।কিন্তু নাগকন্যা,
আমি তোমার প্রিয়কার্য করতে ইচ্ছুক। তোমার ইচ্ছার মর্যাদা দিতে চাই। অর্থাৎ অর্জুন
খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন; উলূপীকে গ্রহন করতে তিনিও ইচ্ছুক কিন্তু সমস্যাটা
নিজের অপর না রেখে সেটা ছেড়ে দিয়েছেন উলূপীর ওপর। অর্জুন বললেন, দেখ না কোনো উপায়
বের করা যায় কিনা যেখানে ব্রহ্মচর্যের নিয়মও লঙ্ঘিত হবে না অথচ তোমার প্রিয় কার্যও
সম্পাদন করা যায়।
উলূপী
যেহেতু এই বিষয়ের অবতারনা করেছিলেন, তাই প্রত্যাশামতোই প্রস্তাবের সমর্থনে যুক্তির
অবতারনা করলেন উলূপী। উলূপী শান্ত অথচ স্থির কন্ঠে বললেন, পাণ্ডুনন্দন, আমি জানি
তোমাদের প্রতিজ্ঞার কথা। কেন তোমার দ্বাদশবর্ষ বনবাস ও নির্বাসন।কেন তোমার
ব্রহ্মচর্য পালন। কিন্তু ব্রহ্মচর্যের যে নিয়ম স্থির হয়েছিল তোমাদের মধ্যে সেটা তো
শুধুমাত্র দ্রৌপদীর সম্বন্ধেই। অপর নারীগ্রহন তো সম্পূর্নভাবে তোমার ইচ্ছার ওপর
নির্ভরশীল।পট্টমহিষী দ্রৌপদী সম্পর্কে যে নিয়ম স্থির হয়েছে তা তো আমার ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য নয়।
উলূপী
একটা যুক্তি খাড়া করলেন বটে, কিন্তু তিনি এটাও বুঝতে পারলেন যে যুক্তি তিনি পেশ
করলেন তার প্রাবল্যের মাত্রা যথেষ্ট কম। তাই যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উলূপী
সংযোগ করলেন, তুমি তো ক্ষত্রিয়। পীড়িতকে পরিত্রান করাই তো ক্ষাত্রধর্ম। আমাকে তুমি
গ্রহন না করলে আমি বাঁচবো না। আমাকে গ্রহন করলে আমার ঈপ্সিত এই মিলনে যদি তোমার
প্রতিজ্ঞাকৃত ধর্মের অনুমাত্রও লঙ্ঘন হয়; তবুও তোমার ধর্ম নষ্ট হবে না, যদি তুমি
আমার জীবন রক্ষা কর। প্রতিজ্ঞা রক্ষার থেকে জীবনরক্ষার ধর্ম অনেক বড়। আমি তো আমার
সর্বস্ব অর্পন করেছি তোমাকে, তুমিও আমার অভিলাষ পূর্ণ কর। তুমি বিশ্বাস কর, আমি
তোমার শরণাগত। আমাকে গ্রহন করে তুমি আমাকে জীবনদান কর। প্রাণরক্ষা কর আমার। এর
থেকে বড় ধর্ম আর কি হতে পারে।
প্রকৃত
অর্থেই অর্জুনের সান্নিধ্যলাভ, অর্জুনের একটু ভালোবাসা পাওয়া, অর্জুনকে একান্তভাবে
কাছে পাওয়া –
উলূপীর কাছে জীবনদান। সেই কাছে পাওয়া যত অল্প সময়ের জন্যই হোক না কেন। বিয়ের
অল্পদিন পরেই স্বামীকে হারান উলূপী। উপরন্তু তিনি নিঃসন্তান। তাই জীবনধারনের
অবলম্বন বলতে তাঁর কিছু নেই।তাই তিনি ক্ষনিকের জন্য হলেও পেতে চেয়েছেন অর্জুনের
ভালোবাসার সাহচর্য; অর্জুনের স্ত্রী স্বীকৃতির মর্যাদা। যে মর্যাদাকে অবলম্বন করে
তিনি কাটাতে চান তাঁর সারাজীবন। এর থেকে বেশী কিছু তাঁর দাবি নেই অর্জুনের কাছে।
অর্জুনও
এবার কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়লেন। উলূপীর নিঃসঙ্কোচ আত্মনিবেদন, তাঁকে পাবার প্রবল
আর্তি দেখে ফাল্গুনীও হয়তো বা উপলব্ধি করলেন উলূপীর ভালোবাসার গভীরতা। আর অন্য
কোনো প্রতিযুক্তি পেশ করলেন না অর্জুন। পূর্ণ করলেন উলূপীর ঈপ্সা, অসম্বাধ করলেন
তাঁর স্বামী পরিচয়ের পথ। শুধু তাই নয় ; পরবর্তী সময়ে তাঁর যে পুত্র জন্মাবে তার
পিতৃপরিচয়ের দায়ও নিয়েছেন অর্জুন। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে যখন ইরাবান কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধে এসেছেন পিতা অর্জুনকে সহায়তা করতে তখন তার পরিচয় বর্ণন প্রসঙ্গে সঞ্জয়
ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, - “স্নুষায়াং
নাগরাজস্য জাতঃ পার্থেন ধীমতা” – ইনি ইরাবান। নাগরাজের পুত্রবধূর গর্ভজাত অর্জুনের
পুত্র।
এ
প্রসঙ্গে একটা কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন যে কিছু মহাভারত চর্চাকার ব্যাখা করবার
প্রয়াস করেন যে, অর্জুন উলূপীকে বিবাহ করেননি। তাঁরা বোঝাতে চান অর্জুন নাগকন্যা
উলূপীর রতিলিপ্সায় সাড়া দিয়ে সম্ভোগ করবার জন্য গ্রহন করেন তাকে।সত্যি বড্ড অবাক
লাগে এ ধরনের সংকীর্নমনা যুক্তির অবতারনা হলে। মহাভারত সঠিকভাবে না পড়ে,মহাভারতের
চরিত্রসমূহকে সঠিকভাবে না বুঝে, মহাভারতকারের আধুনিকমনস্কতাকে না জেনে শুধুমাত্র
রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুনকে এক বিধবা নারীর
পাণিগ্রহন করা থেকে বাঁচাবার কি মারাত্মক অপপ্রয়াস। মহাভারতে সুস্পষ্টভাবে
উল্লেখিত আছে – “ভার্যার্থং তাঞ্চ জগ্রাহ পার্থঃ কামাবশানুগাম্ ।” অর্থাৎ সেই নাগকন্যা (উলূপী) সকামভাবে অর্জুনের
সঙ্গে মিলন কামনা করলে অর্জুন তাঁকে ভার্যারূপে গ্রহন করেন।মহাভারতে এত স্পষ্টভাবে
উল্লেখ থাকা স্বত্ত্বেও এই রক্ষণশীল পণ্ডিতবর্গ যেন এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন
না যে অর্জুন বিধবা রমনীর পাণিগ্রহন করতে পারেন। আমি তাঁদের করজোড়ে নিবেদন করব,
দয়া করে মহাভারতটা একটু ভাল করে পড়ুন।অর্জুনের চরিত্রের যে বিশালতা তা বোঝবার
চেষ্টা করুন। অর্জুনের দৃষ্টি এতটাই উদার, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই আধুনিক, তাঁর
আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় এতটাই সুগভীর যে একজন বিধবা নাগরমনীকে স্ত্রীর মর্যাদা
দান করতে তাঁর মনে কোনোরকম দোলাচলতা স্থান পায় না। বিধবা বলে বিয়ে করব না- এরকম
সংকীর্ন ছ্যুঁৎমার্গ অর্জুনের মধ্যে কোনোদিনই ছিল না। অর্জুন উলূপীকে বিবাহ করেন আর সেটা হয়েছিল উলূপীর পিতা কৌরব্যনাগের সম্মতিতেই। মহাভারতে
ভীষ্মপর্বে এর উল্লেখ আছে স্পষ্টভাবে। ঐরাবতবংশীয় কৌরব্যনাগ
তাঁর শোকসন্তপ্তা অনপত্যা কন্যাকে অর্পন করেন অর্জুনের কাছে। সম্পূর্ন অনাড়ম্বরভাবে অনুষ্ঠিত হয় সেই
বিবাহপর্ব। না বেজেছিল কোনো মঙ্গলশঙ্খ না ছিল
উচ্চজয়কারে উলুধ্বনি। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ এক অদ্ভুত
যুক্তির অবতারনা করেছিলেন, অর্জুনের বনবাসকালে উলূপীর সঙ্গে যোগাযোগের পর আরও অন্য কোনো এক নাগরমনীর
সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হন ফাল্গুনী।আর তারই ফলে জন্ম হয় ইরাবানের। অথচ মূল মহাভারতে
কোনোস্থানে এর উল্লেখ মেলে না। সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় বোঝাতে চান, রতিলিপ্সু নারীকে
তিনি গ্রহন করেন; তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন অথচ তাঁকে ভার্যার
মর্যাদা তিনি দেন না। সত্যি উলূপীর স্ত্রী মর্যাদা খর্ব তো বটেই তার সঙ্গে সঙ্গে
তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুনের চরিত্রেও ভব্যতাহীনতার কালিমালেপনের এক সংকীর্ন প্রয়াস।
মহাভারতে ইরাবানের পরিচয় বর্ননা প্রসঙ্গে খুব সুস্পষ্টভাবে স্পঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে
বলেছেন, অর্জুন কোনো এক নাগরাজের বধূর গর্ভে এই পুত্রের জন্ম দেন। সেই নাগরাজ হলেন
গরুড় কর্তৃক নিহত উলূপীর পূর্বস্বামী। আর সেই উলূপীর পুত্র হলেন ইরাবান। উলূপীর
স্বামীত্ব বা ইরাবানের পিতৃত্ব কখনোই অস্বীকার করেননি অর্জুন।
মহাভারতের
আশ্বমেধিক পর্বে উলূপীকে অর্জুনের ‘ভার্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর যদি বিবাহিতা ‘স্ত্রী’র স্বীকৃতি না থাকতো তবে অশ্বমেধ যজ্ঞের মত সাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে
আমন্ত্রন জুটত না উলূপীর। দ্রৌপদী,সুভদ্রা ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে একই সারিতে স্থান
হত না উলূপীর। অর্থাৎ উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে হয় তার সুস্পষ্ট ও প্রকট প্রমান
মহাভারতে অবশ্যই আছে। অর্জুন স্ত্রীর মর্যাদা উলূপীকে দিয়েছিলেন। আর উলূপীর কাছে এ
ছিল এক বিশাল প্রাপ্তি। এই মর্যাদাটুকুর বেশী উলূপী আর কিছু প্রত্যাশাও করেননি।
সম্পূর্ন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিলেন অর্জুনকে।
অর্জুন
বেশী সময় কাটাননি উলূপীর সঙ্গে । সেই রাত্রিযাপন করে, উলূপীর সমস্ত ঈপ্সা পূর্ণ
করে অর্জুন পরদিন প্রভাতেই ফিরে আসেন গঙ্গাতীরে। অর্জুনকে সকুশলে গঙ্গাতীরে পৌঁছে
দিয়ে যান উলূপী।
উলূপীর
স্বামীর মৃত্যুর পরও কিন্তু শ্বশুরালয়ে উলূপীর একটা আলাদা স্থান ছিল। কিন্তু শ্বশুরবাড়ীর সঙ্গে উলূপীর সম্পর্কের অবনতি হয় উলূপীর সঙ্গে
অর্জুনের পরিনয়ের পর। ভীষ্মপর্বে ইরাবান সম্পর্কে বলার সময় সঞ্জয় বলছেন, অর্জুনের
সাথে বিবাহের পর উলূপীর পূর্বস্বামীর ভ্রাতা অশ্বসেন ভীষণ ক্রুদ্ধ হন উলূপীর
প্রতি। আর এই ক্ষোভ চরম আকার নেয় ইরাবানের জন্মের পর। ইরাবানের পিতৃব্য অশ্বসেন
উলূপী ও তার পুত্র ইরাবানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন অর্জুনের প্রতি
বিদ্বেষে। উলূপীও বাধ্য হন সম্পূর্নভাবে পিত্রালয়ে আশ্রয় গ্রহন করতে।ইরাবান লালিত
পালিত হতে থাকেন তাঁর মা উলূপীর তত্ত্বাবধানে, কৌরব্যনাগের ভবনে।
এখানে
একটা বিষয় একটু ভাববার আছে। অর্জুনের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হবার পর শ্বশুরকুলে
উলূপীর সমস্যা বিশেষত ইরাবানের পিতৃব্য অশ্বসেনের ক্রোধ।আর সেটা সর্বোচ্চ মাত্রা
নেয় ইরাবানের জন্মের পর। মহাভারতে স্বামী মারা গেলে অথবা অক্ষম হলে সেক্ষেত্রে
নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে সন্তানজন্মের উদাহরন তো যথেষ্ট রয়েছে। যেমন
পাণ্ডু-ধৃতরাষ্ট্র জন্মেছিলেন মহারাজ বিচিত্রবীর্যর বিধবা স্ত্রী অম্বিকা ও
অম্বালিকার গর্ভে মহর্ষি ব্যাসের ঔরসে। অথবা পঞ্চপাণ্ডবের জন্মের ক্ষেত্রেও তো এক
অর্থে নিয়োগপ্রথারই প্রয়োগ করা হয়। তাই নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে ক্ষেত্রজ পুত্রের
জন্মদানের ঘটনায় যে ক্রোধের উন্মেষ ঘটতে পারে সেটা কিন্তু মহাভারতে অন্যত্র
অনুপস্থিত। অথচ উলূপীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর তাঁর
ওপর দেবর অশ্বসেনের ক্রোধ এতটাই বর্ধিত হল
যে বাধ্য হয়ে তাঁকে শ্বশুরবাড়ী ত্যাগ করে ফিরে আসতে হল পিত্রালয়ে – কৌরব্যনাগের ভবনে।
মহাভারতের
সময়ে নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের যে যথেষ্ট স্বীকৃতি ছিল তার অনেক
প্রমান খোদ মহাভারতেই আছে। কিন্তু সাধারনত যেটা করা হত তা হল নিয়োগপ্রথার উদ্যোগ
গ্রহন করা হত শ্বশুরকুল থেকে। অনপত্যা উলুপীও বৈধব্য জীবনযাপন করছিলেন। এক্ষেত্রে নিয়োগপ্রথা প্রয়োগ করবার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যার কথা মনে
আসতে বাধ্য তিনি হলেন উলূপীর নিহত স্বামীর ভ্রাতা অশ্বসেন। কারন নিয়োগপ্রথার
মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের উপযোগী হিসেবে প্রথম ভাবা হত – ভাশুর বা দেবর এর কথা । হয়তো বা এধরনের ভাবনা ছিল
উলূপীর শ্বশুরবাড়ীর লোকজনদেরও। কিন্তু ঘটনাক্রম প্রবাহিত হল অন্যদিকে। হরিদ্বারে
স্নানরত অবস্থায় অর্জুনকে দেখে সম্মোহিত হয়ে পড়লেন উলূপী। প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে
ফেললেন অর্জুনকে। উলূপী বুঝেছিলেন অর্জুনের সান্নিধ্য তিনি লাভ করবেন খুব অল্প
সময়ের জন্য। তবুও তিনি তাঁর সর্বস্ব নিবেদন করতে চেয়েছেন ফাল্গুনীকে; বিয়ে করতে
চেয়েছেন তাঁকে।
হয়তো
উলূপীর প্রতি আকর্ষন ছিল তাঁর দেবর অশ্বসেনেরও। ভেবেছিলেন নিয়োগপ্রথার মাধ্যেমে
অথবা অন্য কোনো প্রকারে একদিন তিনিই অধিকারী হবেন উলূপীর। মেয়েরা যেমন
ষষ্ঠেন্দ্রিয়র অনুভূতিতে বুঝতে পারেন পুরুষের নজর তেমনি উলূপীও নিশ্চয় বূঝেছিলেন
দেবর অশ্বসেনের মনোভিলাষ। তাই অর্জুনকে তিনি সোজা নিয়ে এসেছেন তাঁর পিতা
কৌরব্যনাগের ভবনে। আর কৌরব্যনাগ তাঁর এই বিধবা অনপত্যা কন্যাকে সমর্পন করেছেন
অর্জুনের হাতে। তাই অশ্বসেন যখন দেখলেন কৌরব্যনাগ তাঁর কন্যার পুনর্বিবাহ দিয়েছেন
অর্জুনের সঙ্গে তখন তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ হলেন। আর তারপর যখন ইরাবানের জন্ম হল তখন
তার ক্ষোভ এত তীব্র আকার ধারন করল যে শ্বশুরকুলে আর স্থান হল না উলূপীর। ইরাবানও
বড় হয়ে উঠতে থাকলেন মাতৃকুলে; কৌরব্যনাগের আবাসে।
উলূপী
ও ইরাবানের জীবনের এরকম পরিস্থিতির কথা কিন্তু অর্জুন অজ্ঞাত ছিলেন। সেই যে তিনি
কৌরব্যনাগের আবাসস্থল থেকে প্রভাতে ফিরলেন গঙ্গাদ্বারে তারপর থেকে উলূপীর সঙ্গে
তাঁর সমস্তরকম সংযোগ বিচ্ছিন্ন। যদিও উলূপী সেরকম কোনো প্রত্যাশা বা দাবিও কখনো
করেননি অর্জুনের কাছে। উলূপী এক অন্যধরনের রমণী। তিনি যথেষ্ট বেশিমাত্রায় স্মার্ট
(smart)এবং সপ্রতিভ।আর সেইসঙ্গে ভীষণ রকমের আত্মপ্রত্যয়ী। অর্জুনের মত পুরুষের ব্রহ্মচর্যের
বন্ধনকে তিনি শিথিল করে দিয়েছিলেন নিজের স্মার্টনেস (smartness), প্রগলভতা আর
যুক্তি –
প্রতিযুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে।কিন্তু অর্জুনকে কোনো রকম বন্ধন বা শৃঙ্খলে আবদ্ধ
রাখার প্রয়াস করেননি তিনি। একটি রাত্রির জন্য অর্জুনকে পেয়েছিলেন তিনি। সেই
ক্ষনিকসময়ে অর্জুনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ আর অর্জুনের সান্নিধ্যলাভের ঈপ্সাপূরণ – সম্পন্ন হবার পর অর্জুনকে আটকে রাখেননি তিনি।পরদিন
প্রভাতে নিজে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন গঙ্গাদ্বারে।বহুরকমের ঝড়ঝঞ্ঝাট সত্ত্বেও ইরাবানকে
অর্জুনের যোগ্যপুত্রের মত মানুষ করেছেন। অনেকটা আধুনিক যুগের সিঙ্গল মাদার(single
mother)এর মত। আবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন প্রয়োজন হয়েছে; উলূপী কালবিলম্ব না
করে ইরাবানকে পাঠিয়েছেন অর্জুনের কাছে – তাঁকে সাহায্য করবার জন্য।
ইরাবানের
সাথে অর্জুনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ইন্দ্রলোকে। পাশাখেলার পরাজয়ের কারনে পাণ্ডবেরা
তখন বনবাসে। অর্জুন নতুন দিব্যাস্ত্র শিক্ষার উদ্দেশ্যে তখন দেবলোকে। আর এই সময় ইরাবান এসে উপস্থিত হন পাণ্ডবদের অরণ্য
আবাসে অর্জুনের সাথে সাক্ষাৎ করবার অভিপ্রায়ে।সেখানে অর্জুনের দেখা না পেয়ে ইরাবান উপস্থিত হন দেবলোকেই।
অর্জুনের সাথে দেখা হবার পর ধীরকন্ঠে নিজের পুত্রপরিচয় দেবার সময় সবিস্তারে জানান
কিভাবে তাঁর মায়ের সাথে অর্জুনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই – আপন সত্তা প্রতিষ্ঠা। ইরাবান কিন্তু একবারের
জন্যও জানাননি অর্জুনকে কিভাবে তাঁর মা উলূপী শ্বশুরকুল থেকে সম্পূর্ন বিতাড়িত হয়ে
শত অসুবিধার মধ্যেও লালন পালন করেছেন তাঁকে।যা ইরাবানের চরিত্রের দৃঢ়তাই প্রমাণ
করে। হয়তো উলূপীর মত দৃঢ়চেতা ছিলেন তাঁর পুত্র ইরাবানও। শুধু এতটুকুই তিনি
জানিয়েছেন অর্জুনকে, আমি ইরাবান, আপনার পুত্র- আমার মাতার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল
গঙ্গাদ্বারে। অল্প বলাতেই অর্জুনের সব মনে পড়ে যায়। গঙ্গাদ্বারে উলূপীর সাথে
সাক্ষাৎ, কৌরব্যনাগের আবাসে উলূপীর সঙ্গে আনন্দঘন নিশিযাপন আর তার পরদিন প্রভাতেই
আবার গঙ্গাদ্বারের আশ্রমে ফিরে আসা – কোনোকিছুই বিস্মৃত হননি ফাল্গুনী। নিজপুত্রকে দেখে পরম আনন্দিত হলেন
পার্থ। সানন্দে আলিঙ্গন করলেন পুত্রকে।অর্জুন দিব্যাস্ত্র সিদ্ধির জন্য দেবলোকে
এসেছেন। কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ যে ভবিষ্যতে আসন্নপ্রায় সেটা ভালরকম ভাবেই
অনুধাবন করতে পারেছিলেন অর্জুন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই বীর পুত্রটিকে বললেন,
বাছা! কৌরবদের সঙ্গে যখন আমাদের যুদ্ধ আরম্ভ হবে, তুমি তখন সাহায্য করবে আমাদের।
গঙ্গাদ্বারে
অর্জুনকে পৌঁছে দেবার পর অনেকদিন কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না উলূপীর।অর্জুনের সাথে
ছিলনা তাঁর কোনো রকমের যোগাযোগ। অর্জুনের সঙ্গে
উলূপীর সাক্ষাৎ আবার সেই আশ্বমেধিক পর্বে।
কিন্তু সে ঘটনা বিবৃত করবার পূর্বে মনিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার কথা বলা
বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারন উলূপী সেখানে ভীষনভাবে জড়িয়ে আছেন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে।
তাই উলূপীকে জানতে হলে চিত্রাঙ্গদার কথাও কিছুটা জানতে হবে।
চিত্রাঙ্গদার
কথা শুনলেই আমাদের মনে পড়ে যায় কবিগুরুর ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্যর কথা । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
নাট্যকাব্যের সঙ্গে ব্যাসদেব রচিত মূল মহাভারতের কাহিণীর চিত্রাঙ্গদার যথেষ্ট
পার্থক্য। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা অনেক
বেশিমাত্রায় পৌরুষদৃপ্তা। কিন্তু ব্যাসদেবের মহাভারতে চিত্রাঙ্গপদার সেই পৌরুষেয় আচরন
অনুপস্থিত। মহাভারতে শুধু এতটুকুরই উল্লেখ আছে যে, মনিপুরের রাজা চিত্রবাহন তাঁর
কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে পুত্রকল্পে মানুষ করেছেন আর তার বিবাহের পরও তিনি কন্যাকে
নিজের কাছেই রেখে দেবেন। এটা ছাড়া চিত্রাঙ্গদার
অন্যকোনো পুরুষালি আচরনের উল্লেখ মহাভারতে পাওয়া যায় না।
উলূপীর
কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অর্জুন তীর্থ ভ্রমন করতে আসেন পূর্বভারতে। পূর্বভারতে তীর্থ
পরিব্রাজন করে অর্জুন দক্ষিণভারত হয়ে চলে আসেন অনেকটা দক্ষিনপশ্চিমে। সেখানে মহেশ
পর্বতে ঋষিদের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে অর্জুন প্রবেশ করলেন মহেশ পর্বত সন্নিহিত মনিপুর
দেশে। অনির্দেশ্যভাবেই নগরে ভ্রমণ করতে লাগলেন পার্থ। সহসা তিনি দেখতে পেলেন
ভ্রমনরতা মনিপুর রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে।মনিপুরের রাজপথে বিচরন করছিলেন দৃপ্ত
ভঙ্গিমায়।
চিত্রাঙ্গদাকে
দেখামাত্র বিমুগ্ধ, বিমোহিত হয়ে পড়লেন অর্জুন।শূণ্য, স্থির দৃষ্টিতে প্রায় দণ্ডকাল
স্তম্ভসদৃশ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন পার্থ। তাঁর মনে হল এমন অভিরাম, অনির্বচনীয়
সৌন্দর্য্য ইতিপূর্বে তিনি আর দেখেননি। পথচারী মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে
পারলেন – ইনি
মনিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। মনিপুর নরেশ চিত্রবাহনের কন্যা চৈত্রবাহনী
চিত্রাঙ্গদাকে দেখামাত্র যে অর্জুনের ব্রহ্মচর্যের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল তার মূলে
কিন্তু অবশ্যই উলূপীর সেই যুক্তি –
তোমার যত ব্রহ্মচর্য তা শুধু দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আমার ক্ষেত্রে নয়।
উলূপীর এই যুক্তি তাঁর অবচেতন মনে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল।তাই চিত্রাঙ্গদার
পানিগ্রহনের ক্ষেত্রে তিনি আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি। অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে
কোনোকিছু বললেন না। তিনি সোজা উপস্থিত হলেন মনিপুরেশ্বর চিত্রবাহনের সকাশে।
উদ্দেশ্য –
নিজের প্রতিষ্ঠা, বংশপরিচয়ের আভিজাত্য মহারাজ চিত্রবাহনের সম্মুখে বিবৃত করে
চিত্রাঙ্গদার পানিপ্রার্থনা। অর্থাৎ অর্জুন এক্ষেত্রে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাননি।
কারন চিত্রাঙ্গদার সাথে পরিচয় করে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে যদি তিনি প্রস্তাব
প্রত্যাখান করেন তখন অন্যকোনো উপায় থাকবে না। অর্জুনের এই বিশ্বাস ছিল যে তাঁর
পরিচয় জানলে চিত্রবাহন হয়তো তাঁকে হতাশ করবেন না। তাই নিজের পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা
জানিয়ে বিবাহের প্রস্তাব তিনি জানালেন মহারাজ চিত্রবাহনকে।
চিত্রবাহন
ধীর শান্ত কন্ঠে অর্জুনকে বললেন, আমাদের এই বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন।
তিনি অপুত্রক বলে সন্তান কামনায় তপস্যা করেছিলেন।তাঁর ভয়ংকর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে
মহাদেব তাঁকে –
আমাদের বংশে একটি করে সন্তান হবে। সে সন্তান পুত্র হবে কি কন্যা হবে তাঁর কোনো
নির্দিষ্টতা নেই। আমার পূর্বপুরুষদের সবারই একটি করে পুত্রই জন্মেছে। কিন্তু আমার
জন্মেছে একটি কন্যা। কন্যাসন্তান বলে আমি কিন্তু তাকে অবহেলা করিনি। পুত্রকল্পেই
তাকে আমি মানুষ করেছি। আমার এই কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে সেই বিধিমতে আমার
পিণ্ডদাতা পুত্রের কাজ সম্পাদন করবে এবং ভবিষ্যতে মনিপুর রাজ্যের অধীশ্বর হবে।তুমি
যদি এই শর্ত মেনে নাও তবেই চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে তোমার পরিণয় সম্ভব। অর্থাৎ স্পষ্ট
করে না বললেও চিত্রবাহন অর্জুনকে বোঝাতে চেয়েছেন বিয়ের পরও তিনি চিত্রাঙ্গদাকে
তিনি শ্বশুরালয়ে যেতে দেবেন না।
চিত্রাঙ্গদাকে
দেখে অর্জুন এতটাই বিমুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কালক্ষেপ না করে তৎক্ষণাৎ সম্মত হলেন
রাজা চিত্রবাহনের প্রস্তাবে। পরিনয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে। চিত্রাঙ্গদার
প্রতি এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন অর্জুন যে তাঁর দ্বাদশবর্ষ বনবাসের প্রায় এক চতুর্থাংশ
তিনি অতিবাহিত করলেন মনিপুর রাজভবনে। এই সময়ের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হলেন
চিত্রাঙ্গদা।অর্জুন এবার উপলব্ধি করলেন বনবাস জীবনের একটা বড় অংশ তিনি অতিবাহিত
করেছেন মনিপুর রাজভবনে চিত্রাঙ্গদার সান্নিধ্যে। সুপ্তোত্থিতের মত সচেতন হলেন
ফাল্গুনী। চিত্রাঙ্গদার কাছ থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে তিনি পুনরায় শুরু করলেন
তীর্থভ্রমন।
যদিও
বেশি সময় তীর্থভ্রমন করতে পারলেন না অর্জুন। কারন চিত্রাঙ্গদা অন্তঃসত্ত্বা। তাই
বছরখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে এলেন মনিপুরে। এসে দেখলেন তাঁর সমস্ত লক্ষন নিয়েই
চিত্রাঙ্গদার কোল আলো করে দেবশিশুর মত এক পুত্র জন্মেছে।নামকরন করা হয়েছে
বভ্রুবাহন।অর্জুন মহারাজ চিত্রবাহনকে যে কথা দিয়েছিলেন তা বিস্মৃত হননি। নিজপুত্র
বভ্রুবাহনকে রাজা চিত্রবাহনের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, চিত্রাঙ্গদার অধিকারী হবার
শুল্কস্বরূপ বভ্রুবাহনকে আপনি গ্রহন করুন। বভ্রুবাহনের মাধ্যমেই আমি আপনার ঋণমুক্ত
হব।
অর্জুন
এবার পাকাপাকিভাবে মনিপুর ছেড়ে চলে যাবেন। যাবার আগে বিদায় জানাতে এসে
চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, তুমি এখানে মনিপুরেই থাক। ভালো থেকো। বভ্রুবাহনকে মানুষ করে
তোলো। একবার এসো আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থে।
সেখানে জননী কুন্তী,
মহারাজ যুধিষ্ঠির , দাদা ভীম,আমার কনিষ্ঠ দুই ভ্রাতা নকুল আর সহদেব আছেন।সবার সাথে
পরিচয় হলে তোমার ভাল লাগবে।অর্জুন হয়তো ভাবছিলেন কোনো কারন ছাড়া এমনি এমনি
চিত্রাঙ্গদা যাবেন না ইন্দ্রপ্রস্থে। তাই আবারও বললেন অর্জুন – মহারাজ যুধিষ্ঠির যে অখণ্ড ধৈর্য নিয়ে ধর্মের পথে
থেকে রাজ্যশাসন করছেন, তাতে অবশ্যই তিনি একদিন রাজসূয় যজ্ঞ করবেন।তোমার পিতাও বহু
রত্ন উপঢৌকন নিয়ে সেই যজ্ঞানুষ্ঠানে আসবেন। তখন তুমি এসো। সেসময় এলে একবার অন্তত
তোমার দেখা হবে আমার সঙ্গে। অর্জুন বুঝতে পারছিলেন তিনি যেমন ভীষন ভালোবাসেন
চিত্রাঙ্গদাকে তেমনি এই তিন বছরে চিত্রাঙ্গদাও ভালোবেসে ফেলেছিলেন অর্জুনকে।তাই
চিত্রাঙ্গদাকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বললেন, আমি চলে যাচ্ছি বলে আমার বিরহে তুমি
কষ্ট পেয়ো না।আমার পুত্র বভ্রুবাহন তো রইল তোমার কাছে। জানবে সে আমার বহিশ্চর
প্রাণ। মহারাজ চিত্রবাহনের রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী
হলেও প্রসিদ্ধ পুরুবংশের জন্য আনন্দসংবাদ নিয়ে এসেছে সে। আমার সন্তান হলেও সে
আমাদের পাঁচ ভাইয়ের প্রিয়তম পুত্রের সমান। তার দায়িত্ব নিয়ে লালনপালন করে মানুষ
করে তোলো তাকে।
যুধিষ্ঠিরের
রাজসূয় যজ্ঞে কিন্তু চিত্রাঙ্গদার উপস্থিতির কথা মহাভারতে বর্নিত হয়নি। এসেছিলেন
না আসেননি কোনোকিছুরই বর্ননা নেই সেখানে। আর উলূপীর তো প্রশ্নই নেই আসবার।
রাজসূয়যজ্ঞে আমন্ত্রনলাভের সৌভাগ্যটুকুও তো হয়নি তাঁর। উলূপীকে তো একবারের জন্যও
বলেননি অর্জুন রাজসূয়যজ্ঞে ইন্দ্রপ্রস্থে আসবার জন্য।এতটাই ব্রাত্য তিনি।
উলূপীর
কথা আবার মহাভারতে এসেছে যখন পাণ্ডবদের বনবাসযাপনের সময় ইরাবান সাক্ষাৎ করতে
এসেছেন পিতা অর্জুনের সঙ্গে। আর মহাভারতের ভারতযুদ্ধের সময় কিন্তু সকৃতজ্ঞ চিত্তে
স্মরণ করতে হয় উলূপীর কথা। চিত্রাঙ্গদার প্রতি অর্জুনের আকর্ষন উলূপী অপেক্ষা বেশী
ছিল। অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কিন্তু চিত্রাঙ্গদা তাঁর পুত্র বভ্রুবাহনকে পাঠাননি
পাণ্ডব তথা অর্জুনের সাহায্যার্থে।অন্যদিকে উলূপীকে দেখুন। কতটুকু তিনি পেয়েছেন
অর্জুনের কাছ থেকে – সেই
এক রাত্রির ক্ষনিকের ভালোবাসা।অথচ তিনি তাঁর গর্ভজাত একমাত্র সন্তান অর্জুনের
ক্ষেত্রজ পুত্র ইরাবানকে পাঠিয়েছেন মহাভারতের সেই ভারতযুদ্ধে। অর্জুনের জন্য ভীষণ
রকমের ভাবনা ছিল উলূপীর।তাই হয়তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের কুশলতার জন্য একটা
দুশ্চিন্তা, একটা আশঙ্কা তাঁর ছিলই। সে অর্জুন যত বড় বীর,যত বড় যোদ্ধাই হোন না
কেন। তাই উলূপী যুদ্ধে ইরাবানের প্রানসংশয় হতে পারে জেনেও তাকে পাঠিয়েছিলেন
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে পিতা অর্জুনের সাহায্যার্থে। এতটাই ছিল উলূপীর ভালোবাসার
গভীরতা।
উলূপীর
এই বীর পুত্রটি এসেছিলেন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে পাণ্ডবদের সাহায্য করাবার
জন্য।অর্জুনের সুযোগ্য পুত্র হিসাবে যথেষ্ট সমরকুশলতার পরিচয় দিয়েছিলেন ইরাবান।
শকুনির ছয়জন ভ্রাতাকে যুদ্ধে বধ করেছিলেন মহাবীর ইরাবান।কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত
দুর্যোধন অল্মবুষ রাক্ষসকে নিয়োগ করেন ইরাবানকে ধ্বংস্ব করবার জন্য। অসাধারন
বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও প্রাণ হারাতে হয় ইরাবানকে।
মহাভারতে
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এক অনাড়ম্বর মৃত্যুবরন করলেন উলূপীনন্দন ইরাবান।অর্জুনের
কাছে সে সংবাদ ভালোমত পৌঁছায়নি। এমনকি সন্তানের মৃত্যুতে কতটা শোকসন্তপ্তা
হয়েছিলেন উলূপী সেটাও বর্নিত হয়নি মহাভারতে।অথচ অভিমন্যুর মৃত্যুর পর সুভদ্রার
যন্ত্রনা অথবা পঞ্চপুত্রের মৃত্যুর পর দ্রৌপদীর হাহাকার যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে
বর্নিত হয়েছে মহাভারতে।সত্যি উলূপী বোধহয় এতটাই নগন্য এই মহাভারত মহাকাব্যে যে
তাঁর পুত্রশোকও বর্নিত হয়নি কাহিনীতে। আর অভিমন্যু মৃত্যুর পর প্রতিশোধ স্বরূপ
জয়দ্রথ বধ অথবা দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের হত্যার পর অশ্বত্থামার মস্তকের মনি উৎপাটনের
মত প্রতিশোধস্পৃহা তো দূরে থাক ইরাবানের মৃত্যুর সংবাদটাই ভালোভাবে পৌঁছায়নি
অর্জুনের কাছে। মহাভারতে কেবলমাত্র এতটুকুই বর্নিত আছে ইরাবানের মৃত্যুসংবাদ শুনে
শোকাবিষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুন ভীষ্ম, দ্রোণ ইত্যাদিকে আক্রমন করলেন। এর থেকে
বেশী কিছু আর নয়।
কিন্তু
যতই উপেক্ষা থাক না কেন উলূপী শুধুমাত্র অর্জুনের স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েই পরম
সন্তুষ্ট ছিলেন।তিনি শুধু নিজের সবটুকু দিয়ে অর্জুনকে ভালোবেসেছেন, বিনিময়ে কি
পেয়েছেন আর কি পাননি, তাই নিয়ে অঙ্ক কষতে যাননি।অর্জুনের জন্য, অর্জুনের ইহকাল আর
পরকালের জন্য ভীষন রকমের চিন্তা ছিল এই নাগকন্যাটির।আর এর প্রমান মেলে মহাভারতে
বর্নিত কাহিনীতেই।
তখন
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে। রাজা হয়েছেন যুধিষ্ঠির।যুদ্ধে বহুতর
জ্ঞাতিহত্যার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ মহর্ষিরা যুধিষ্ঠিরকে পরামর্শ দিয়েছেন অশ্বমেধ
যজ্ঞ করবার।যজ্ঞের নিয়মানুসারে গাণ্ডীবধন্বা অর্জুন বেরলেন যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে। কোনো
রাজ্যে যুদ্ধে জয়লাভ করে কোথাও বা বশ্যতা অধিকার করে অর্জুন উপস্থিত হলেন মনিপুর
রাজ্যে। মনিপুরের রাজা তখন চিত্রাঙ্গদাপুত্র বভ্রুবাহন।
মনিপুরে
অর্জুন অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করবার পরই সে খবর রাজা বভ্রুবাহনের গোচর হল যে – তাঁর পিতা তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুন অশ্বমেধের ঘোড়া
নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন মনিপুরে।বভ্রুবাহনের জন্মের পর পরই মনিপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন
অর্জুন। অর্জুনকে কোনোদিন দেখেনওনি বভ্রুবাহন। আজ যখন অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে অর্জুন
উপস্থিত হয়েছেন মনিপুরে তখন বভ্রুবাহন অর্জুনের বশ্যতা স্বীকার করে নেবেন – এটাই স্বাভাবিক। তাই বিধিসম্মতভাবে ব্রাহ্মণ
মহর্ষিদের নিয়ে প্রণামীর ধন সহকারে বভ্রুবাহন উপস্থিত হলেন অর্জুন সকাশে পরম
শ্রদ্ধা সহকারে।
অর্জুন
কিন্তু পুত্রের এই বিনীত বিনম্র আচরন দেখে প্রীত হলেন না। বরং পুত্রে্র শৌর্য্য
বীর্য সম্পর্কে সন্দিহান হলেন ফাল্গুনী।ক্ষত্রিয় সন্তানের এমন বিনীত বশংবদ আচরনে
যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হলেন অর্জুন। এমনকি ভৎসনা করলেন বভ্রুবাহনকে।বললেন, তোমাকে দেখে তো
মনে হচ্ছে না তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করছ।আমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাশ্ব
রক্ষার্থে যুদ্ধের মাধ্যমে তোমাকে বশ্যতা স্বীকার করাতে এসেছি আর তুমি কিনা
স্ত্রীলোকের মত আমাকে বরন করে নিতে এসেছ?আমি যদি নিরস্ত্র অবস্থায় তোমার সমীপে
উপস্থিত হতাম তবে তোমার এই আচরন সংগত হত। নরাধম কুলাঙ্গার কোথাকার।
অর্জুনের
এই ক্ষোভ অপ্রাসঙ্গিক নয়। অর্জুন প্রত্যক্ষ করেছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অসীম
বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ আহুতি দিয়েছেন তাঁর দুই পুত্র অভিমন্যু ও ইরাবান।
সেখানে বভ্রুবাহন তো সেই মহাযুদ্ধে যোগদান করেননি। উপরন্তু আজ শ্রদ্ধাবনত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে এসেছেন।তাই পিতা হিসেবে
অর্জুনের এই দুঃখ, এই উষ্মাপ্রকাশ যথেষ্ট স্বাভাবিক।
আর ঠিক
এই সময়েই মহাভারতে আবার দেখা মেলে উলূপীর। মহাভারতের বর্ননা অনুসারে অর্জুন যখন
বভ্রুবাহ্নকে তিরস্কার করছেন তখন সহসা ভূমিভেদ করে সেখানে উপস্থিত হলেন নাগদুহিতা
উলূপী।মেদিনীভেদ করে সহসা উলূপীর আগমন কতটা বাস্তবতার সাক্ষর বহন করে সেটা
তর্কসাপেক্ষ বিষয়। আমরা সে তর্কে যাবো না। আমরা মনোনিবেশ করব ঘটনাপ্রবাহের দিকে। উলূপী অর্জুন আর বভ্রুবাহনের কথোপকথনের
মধ্যে উপস্থিত হলেন সেটাই এখনকার আলোচ্য বিষয়।
এক
সংকটজনক মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছেন উলূপী। অথচ এমন পরিস্থিতিতেও তাঁর সৌন্দর্য্য বর্নিত আছে মহাভারতে। এই মাঝবয়সেও তিনি
অপরূপ সুন্দরী। উলূপী প্রত্যক্ষ করলেন অর্জুনের ভৎসনা সত্ত্বেও বভ্রুবাহন অধোবদনে
দাঁড়িয়ে আছেন – ভেবে
চলেছেন যুদ্ধ করা উচিত হবে কিনা, সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। উলূপী তখন বভ্রুবাহনের
কাছে গিয়ে বললেন, পুত্র, আমি নাগকন্যা উলূপী; তোমার বিমাতা।ইনি হলেন তোমার পিতা
মহাবীর অর্জুন।তুমি নির্দ্বিধায় তোমার যুদ্ধভিলাষী পিতার সঙ্গে যুদ্ধ কর। তাহলেই
উনি প্রীত হবেন। তোমারও প্রকৃত ধর্মপালন করা হবে। বভ্রুবাহনকে যুদ্ধের জন্য
যথাসম্ভব উৎসাহিত করলেন উলূপী।
বিমাতা
উলূপীর বাক্যে উৎসাহিত হয়ে বভ্রুবাহনও সমরসজ্জায় সজ্জিত হয়ে রথে আরোহন করলেন।যুদ্ধ
আরম্ভ হল অর্জুন ও বভ্রুবাহনের। তুমুল যুদ্ধ হল পিতাপুত্রের মধ্যে। বভ্রুবাহনের পরাক্রম দেখে ভীষণ প্রীত হলেন অর্জুন। আর
এই যুদ্ধের ফল হল সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিত।বভ্রুবাহনের কাছে পরাজিত হলেন ফাল্গুনী।যুদ্ধে প্রাণ
হারালেন অর্জুন।মহাভারতের বর্ননা অনুসারে বভ্রুবাহনের বানে গুরুতর আহত হয়ে ভূতলে
পতিত হলেন অর্জুন। অর্জুন মৃত্যুবরন করেছিলেন নাকি
সাময়িকভাবে মুর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন তা স্পষ্টভাবে মহাভারতে বলা নেই। এ প্রসঙ্গে
নৃসিংহ প্রসাদ
ভাদুড়ী মহাশয় খুব ভালো ব্যাখা করে বলেছিলেন, “পরবর্তীকালে উলূপীর ভালোবাসার মাহাত্ম্যকে যদি
বেশি করে স্বীকার করতে হয় তাহলে বলা ভাল – অর্জুন সাময়িকভাবে মারা গেলেন।” এদিকে পিতাকে মৃতপ্রায় ও ভূপতিত দেখে বভ্রুবাহনও
মূর্ছিত হয়ে পড়লেন রণক্ষেত্রেই।
সংবাদ
পৌঁছাল মনিপুররাজমাতা চিত্রাঙ্গদার কাছে। স্বামী মৃত আর পুত্র ভূতলে পতিত শুনে
তৎহ্মণাৎ রণাঙ্গনে উপস্থিত হলেন চিত্রাঙ্গদা।রণস্থলে পতিপুত্রকে পতিত দেখে শোকার্ত
বিমূঢ় হয়ে পড়লেন চিত্রাঙ্গদা।আর এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করলেন উলূপীকেই। বললেন,
দেখো উলূপী - তুমি দেখো, তোমার স্বামীর অবস্থাটা তুমি দেখো। তুমিই আমার পুত্রকে
উৎসাহিত করে মহাবীর অর্জুনকে বধ করিয়েছ।
চিত্রাঙ্গদা
উলূপীকে অর্জুনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর মর্যাদা ভুললেন না। আর
অর্জুনের প্রতি উলূপীর ভালোবাসা যে অপরিসীম সেটাও তিনি খুব ভালোভাবে অবগত ছিলেন।
তাই তার অব্যবহিত পরেই বললেন, স্বামী অর্জুনের প্রতি তোমার নিষ্ঠাও তো প্রশ্নাতীত।
তো হঠাৎ তোমার কি হল যে তোমার প্ররোচনায় তোমার স্বামী নিহত হলেন। অর্থাৎ
চিত্রাঙ্গদা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না; যে উলূপী অর্জুনকে প্রাণাধিক
ভালোবাসেন তিনি কিভাবে বভ্রুবাহনকে প্রণোদিত করলেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য।আবার
তার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার অবচেতনে এটাও মনে হতে থাকল – উলূপীর নিশচয় কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে যার মাধ্যমে
আবার তিনি অর্জুনকে পুনর্জীবন দান করতে পারেন। সেটা না হলে উলূপী কিভাবে তাঁর
প্রিয়তম অর্জুনকে মৃত্যুর কালরাত্রির
অঙ্কে শায়িত দেখেও এতটা ভাবলেষহীন রয়েছেন।তাই চিত্রাঙ্গদা বললেন, তুমি
ধর্মশীলা,পতিব্রতা –
কিন্তু স্বামীকে মৃত দেখে কোনো অনুতাপ হচ্ছে না? আমার সন্তানও ভূপতিত। সেজন্য আমি
ভাবিনা। কিন্তু আমার স্বামীর জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যদি তোমার স্বামী তোমার
প্রতি কোনো অন্যায় করে থাকেন তো তুমি তাঁকে ক্ষমা কর। তুমি ধনঞ্জয়কে আবার জীবিত কর
– “ক্ষমস্য যাচমানা বৈ জীবয়স্ব ধঞ্জয়ম্।” আবার এতকিছুর মধ্যেও উলূপীকে একটু তিরস্কার না
করেও পারলেন না চিত্রাঙ্গদা। তিনি বললেন, এত সবকিছু জেনেবুঝেও প্রকৃত ধর্ম কি
সেটাই তুমি বোঝো না। নাহলে পুত্রের মাধ্যমে পিতাকে মৃত্যুমুখে পাঠিয়ে দিয়েও তোমার
কোনো অনুশোচনা নেই!বেশ নির্বিকার আছ তুমি – “যদ্
ঘাতরিতা পুত্রেণ ভর্তারং নানুশোচসি।”
শোকে
আকুল হয়ে পড়লেন চিত্রাঙ্গদা। রণক্ষেত্রে শায়িত অর্জুনের কাছে গিয়ে বিলাপ করতে
থাকলেন। বললেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের যে যজ্ঞাশ্ব আমার পুত্র বন্ধন করেছিল তা আমি
মুক্ত করে দিলাম। তোমাকে তো এই অশ্বের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আরো কত রাজ্যে যেতে
হবে। এখন তুমি যদি রণক্ষেত্রে শায়িত থাকো তবে সেইকাজ সম্পন্ন হবে কিভাবে?
চিত্রাঙ্গদা
শোকে তখন বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। আবার বললেন উলূপীকে, আমার পুত্রকে উদ্দীপিত, উত্তেজিত
করে তুমি আমার স্বামীর প্রাণনাশ করেছ। আজ আবার যদি তুমি আমার স্বামীকে জীবিত না
দেখাতে পারো; তবে আমি আমার এই জীবন ত্যাগ করব।স্বামী সন্তানহীনা হয়ে আমার
জীবনধারনের কোনো অর্থই হয় না। এই রণস্থলেই আমি প্রায়োপবেশন করব। অর্থাৎ
চিত্রাঙ্গদার মনে এখনও স্থির নিশ্চল বিশ্বাস যে উলূপী কোনো কারন ছাড়া একাজ করতে
পারেন না।আর যখন তিনি তা করেছেন তখন নিশ্চয়
অর্জুনের জীবনদানের কোনো উপায় তাঁর জানা আছে।
ইতোমধ্যে
বভ্রুবাহন সংজ্ঞালাভ করলেন।রণাঙ্গনে পিতাকে
মৃতপ্রায় দেখে তিনিও ভীষণ শোকার্ত, অনুশোচনাগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কুমার বভ্রুবাহনও মাতার
অনুগামী হয়ে প্রায়োপেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন।
এতক্ষন
পর্যন্ত কিন্তু উলূপী স্থির নির্বিকার ছিলেন।চিত্রাঙ্গদা বভ্রুবাহনের এত কথার
প্রত্যুত্তরেও তিনি একটাও কথা বলেননি। কিন্তু চিত্রাঙ্গদা আর কুমার বভ্রুবাহনের
এমন শোকবিহ্বল অবস্থা প্রত্যক্ষ করে উলূপী এবার ক্রিয়াশীল হলেন।পরিস্থিতির রাশ
নিয়ন্ত্রনে সচেষ্ট হলেন নাগনন্দিনী উলূপী। উলূপী তখন নাগজাতির পরম ভরসার সঞ্জীবন
মণির স্মরণ করলেন।স্মরণমাত্র সঞ্জীবন মণি উপস্থিত হল। উলূপী সেই সঞ্জীবন মণি
শোকাকুল, বিহ্বল বভ্রুবাহনের হাতে দিয়ে বললেন, পুত্র ওঠো; দুঃখ কোরো না। তুমি
তোমার পিতা অর্জুনকে হত্যা করনি। তুমি তাঁকে মারতেই পারো না।দেবরাজ ইন্দ্রও যদি
সমস্ত দেবতাদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে আসেন; তবুও অর্জুনকে জয়
করতে পারবেন না।তোমার পিতার প্রীতির জন্যই আমি ‘মোহিনী’ নামে এক মায়া প্রয়োগ করেছি।তোমার পিতা অর্জুন
তোমার ক্ষাত্রশক্তি প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন। তাই তোমাকে আমি যুদ্ধে প্রণোদিত করেছি। তোমার কোনো
অনিষ্টসাধন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তুমি এই অলৌকিক সঞ্জীবন মণিটি তোমার পিতা
অর্জুনের বক্ষস্থলে স্থাপন কর। তাহলেই তুমি দেখবে তোমার পিতা আবার জীবিত হয়ে
উঠবেন।
উলূপীর
অভিষ্ট মতো বভ্রুবাহন সঞ্জীবন মণিটি অর্জুনের বক্ষে স্থাপন করলেন। সঞ্জীবন মণি
বক্ষে স্থাপন করামাত্র অর্জুন যেন দীর্ঘনিদ্রা থেকে গাত্রোত্থান করলেন। অর্জুন
জীবনলাভ করবার সাথে সাথেই চতুর্দিকে আনন্দের রব উঠল।বভ্রুবাহঙ্কে আলিঙ্গন করে তার
মস্তক আঘ্রান করলেন অর্জুন। আর তারপরই ফাল্গুনীর নজর পড়ল উলূপী আর চিত্রাঙ্গদার
দিকে।অর্জুন যথেষ্ট বিস্ময়াভিভূত হলেন চিত্রাঙ্গদা আর উলূপীকে দেখে।চিত্রাঙ্গদাকে
কিছুটা শোকবিহ্বল দেখালেও উলূপী কিন্তু যথেষ্টমাত্রায় স্বাভাবিক। অর্জুন তাই বেশ
অবাক হয়ে বভ্রুবাহনকে প্রশ্ন করলেন, কি এমন ঘটনা ঘটেছে পুত্র যেখানে শোকের ছায়াও
আছে, বিস্ময়ও আছে আবার আনন্দও আছে। তুমি তো আমার আদেশেই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছ
কিন্তু এই রণক্ষেত্রে নাগরাজতনয়া উলূপীই বা কেন এসেছেন? আর তোমার জননী চিত্রাঙ্গদাই
বা এখানে উপস্থিত কেন? অর্থাৎ অর্জুন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁর দুই স্ত্রী
উলূপী আর চিত্রাঙ্গদা রণক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন কেন।বভ্রুবাহন পিতার প্রশ্নের
বিশেষ কোনো উত্তর দিলেন না।শুধু বললেন, উলূপীমাতাকে আপনি জিজ্ঞাসা করুন।
বভ্রুবাহনের
উত্তর থেকে অর্জুন খুব সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন যে, সমস্ত ঘটনার প্রধান রাশ
নিয়ন্ত্রন করছেন নাগনন্দিনী উলূপী। অর্জুন উলূপীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
নাগরাজনন্দিনী। তুমি হঠাৎ মনিপুরপতি বভ্রুবাহনের রাজ্যে এসেছ কেন? আর এই
রণক্ষেত্রেই বা তোমাকে আর চিত্রাঙ্গদাকে দেখছি কেন?অর্থাৎ অর্জুনের কোনোভাবেই
বোধগম্য হচ্ছে না যুদ্ধক্ষেত্রে সহসা উলূপী আর চিত্রাঙ্গদার আগমনের হেতু।অর্জুন আবার বললেন উলূপীকে, তুমি মনিপুরে এসেছ তাই
জিগ্যেস করছি। তুমি রাজা বভ্রুবাহনের মঙ্গলাভিলাষ কর তো? আর তার সাথে আমারও
মঙ্গলকামনা করতো?অজ্ঞাতবশত আমি অথবা আমার পুত্র বভ্রুবাহন তোমার প্রতি কোনো অন্যায়
আচরণ করেনি তো। আর চিত্রবাহনতনয়া তোমার সপত্নী চিত্রাঙ্গদা এমন কিছু করেনি তো যা
তোমার ভালো লাগেনি বা কোনো অন্যায় অপরাধ করে ফেলেছে।
এখানে
একটা বিষয় আবারও লক্ষ্য করার মত যে, যখন চিত্রাঙ্গদা উলূপীর সাথে কথোপকথন করছিলেন
তখন অর্জুনের প্রসঙ্গ এলেই বারংবার উলূপীকে “তোমার স্বামী” বলে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদাও খুব
ভালোভাবে অবহিত ছিলেন যে উলূপী অর্জুনের বিবাহিতা স্ত্রী।আবার জীবনলাভ করবার পর বা
জীবনলাভ করবার পর বা চৈতন্য ফিরে পাবার পর অর্জুনও চিত্রাঙ্গদাকে চিহ্নিত করেছেন
উলূপীর ‘সপত্নী’ হিসাবে।স্পষ্টতঃ এটা অনুধাবন করতে অসুবিধে হয়না
যে অর্জুনও উলূপীকে নিজের স্ত্রী রূপে পরিচয় দিতে সামান্যতম কুন্ঠাবোধ করছেন
না।মহাভারতের বর্ণনা আবারও প্রমান করল যে উলূপী অবশ্যই তৃতীয়পাণ্ডব অর্জুনের
বিবাহিতা স্ত্রী।
উলূপীর
সঙ্গে বহুকাল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অর্জুনের। আর আজ যখন সাক্ষাৎ হল সেটাও এক চরম
সংকটজনক মুহূর্তে; রণক্ষেত্রে। অর্জুন কিন্তু উলূপীকে ভোলেননি।তাই তাঁর প্রশ্নের
মধ্যেও রয়েছে মর্যাদার ছাপ।বারবার বলেছেন - কোনো অপরাধ হয়নি তো।অর্জুন এটা যথেষ্ট ভালোভাবে জানেন যে, তাঁর প্রতি উলূপীর ভালোবাসার
গভীরতা কতটা। উলূপী প্রথম যখন অর্জুনকে দেখেছিলেন তখন অবশ্যই তিনি প্রধানত আকৃষ্ট
হয়েছিলেন অর্জুনের প্রতি শারীরিক কামনায়। কিন্তু যত সময় অতিবাহিত হয়েছে উলূপীর
অর্জুনের প্রতি ভালোবাসার পরিমান উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে আজ তা এক শাশ্বত
ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।তামসিকতা থেকে সাত্বিকতায় উপনীত হয়েছে নাগনন্দিনী উলূপীর
প্রেম।অর্জুনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকুক বা না থাকুক; অর্জুন তাঁর খোঁজখবর রাখুন
বা নাই রাখুন –
উলূপী সেসব নিয়ে ভাবিত নন।তিনি অর্জুনকে মনপ্রান দিয়ে ভালোবাসেন এটাই তাঁর কাছে
সর্বৈব সত্যি।তাই অর্জুন যখন এতগুলো প্রশ্ন করলেন উলূপীকে তখন স্মিতহাস্যে উলূপী
বললেন, তুমি কোনো অপরাধ করোনি আমার কাছে। আর কুমার বভ্রুবাহন বা চিত্রাঙ্গদাও কোনো
অন্যায় করেনি আমার সাথে।
উলূপী
এবার মূল ঘটনার রহস্যোন্মচনে তৎপর হলেন।বললেন, আমার প্রতি তুমি রাগ কোরো না। আমি
যা করেছি তোমার ভালর জন্যই করেছি।তোমার পূর্বকৃত পাপের শাস্তিস্বরূপ কুমার
বভ্রুবাহনের হাতে মৃত্যুবরন করে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে
তুমি মহামতি ভীষ্মকে শিখণ্ডীর সহযোগিতায় অন্যায় যুদ্ধে নিপাতিত করেছিলে।সেই
অন্যায়ের শাস্তি ভোগ না করে যদি তুমি মৃত্যুবরন করতে , তাহলে কর্মফল অনুসারে তোমার
নরকে গতি হত- “মহাভারতযুদ্ধে
যত্বয়া শান্তনবো নৃপঃ। অর্ধমেন হতঃ পার্থ! তসৈষা
নিষ্কৃতিঃ কৃতা।।” আর
আজ বভ্রুবাহনের কাছে তোমার যে অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েছিল, এ হল সেই পাপের শাস্তি – “ এষা
তু বিহিতা শান্তিঃ পুত্রাদ্ যদ্ প্রাপ্তবানসি।”
উলূপী
আরো বললেন। তিনি বললেন, পূর্বে ভীষ্ম নিহত হলে বসুগন গঙ্গাতীরে এসে গঙ্গাস্নান
করবার পর দেবী গঙ্গাকে বলেহিলেন –
শান্তনুনন্দন ভীষ্ম রণক্ষেত্রে অস্ত্র পরিত্যাগ করেছিলেন, সেই অবস্থায় অর্জুন
শিখণ্ডীকে সামনে রেখে তাঁকে বধ করেছেন। আমরা এই কারনে আজ অর্জুনকে অভিসম্পাত করব।
বসুদেবগনের সাথে গঙ্গার কথোপকথন হল আর গঙ্গাদেবীও এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন।আমি এই
সংবাদ শুনে ভীষন দুঃখিত হলাম আর সমস্ত ঘটনা আমার পিতাকে জানালাম।(এখানে মনে রাখা
প্রয়োজন যে উলূপী হরিদ্বারের আবাসিক আর এই সংবাদ উলূপীর কর্ণগোচর হওয়া অতিমাত্রায়
স্বাভাবিক।)আমার পিতা কৌরব্যনাগও সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে অত্যন্ত বিহ্বল হলেন।তারপর
আমার পিতা বারংবার বসুগনের সমীপে তোমার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলেন।বসুগন তখন
আমার পিতাকে বলেছিলেন, অর্জুনের পুত্র মনিপুরাধিপতি কুমার বভ্রুবাহন রণক্ষেত্রে অর্জুনকে ভূতলশায়ী করবেন আর তারপরই অর্জুন
আমাদের শাপমুক্ত হবেন। পিতার কাছ থেকে এই সংবাদ শুনে আমি তোমাকে শাপমুক্ত করতে
এসেছি এই মনিপুরে।
উলূপীর
বক্তব্য শুনে বোঝা গেল তাঁর মনিপুরে আগমনের উদ্দেশ্য আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কুমার
বভ্রুবাহনকে পিতা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে প্ররোচিত করবার কারন।বভ্রুবাহনের সঙ্গে
যুদ্ধে পরাজয়ের কারনে কোনোভাবে যদি অর্জুনের স্বাভিমানে আঘাত লেগে থাকে সেখানেও
সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে উলুপী বলছেন, একথা সর্বজনবিদিত পার্থ; যে স্বয়ং দেবরাজ
ইন্দ্রও যুদ্ধে তোমাকে পরাজিত করতে পারবেন না।সেখানে পুত্রের কাছে তুমি পরাজিত
হয়েছ, তাতে গ্লানি বা অপমানের কিছু নেই। কারন স্মৃতিশাস্ত্রে তো বলা আছে পুত্র
আত্মাস্বরূপ। তাই আমার তো মনে হয় পুত্র কর্তৃক পরাজয় কোনো দোষের নয়। তোমার কি মনে
হয়?
উলূপীর
কাছে সমস্ত বিবরন শুনে চিত্ত প্রসন্ন হয়ে উঠল অর্জুনের।উলূপীকে বললেন,
দেবি, তুমি যা করেছ সব আমার ভালোর জন্যই করেছ, সমস্তকিছুই আমার ভালোর জন্যই করেছ;
সমস্তকিছুই আমার খুব ভালো লেগেছে। এখানে আবারও একটা বিষয় লক্ষ্য করবার মত।অর্জুন
উলূপীকে সম্বোধন করেছেন ‘দেবী’ বলে।এর আগেও যখন উলূপীকে সম্বোধন করে কথোপকথন
শুরু করেছিলেন সেখানেও ছিল সমর্যাদ সম্ভাষন; আর এখানেও উলূপীকে ‘দেবী’ সম্ভাষণ করে আবারও তাঁকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন ফাল্গুনী।
এবার
অর্জুন বভ্রুবাহনের কাছে গিয়ে বললেন, আগামী চৈত্র পূর্ণিমায় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের
অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে।তুমি তোমার দুই মাতা আর মন্ত্রী অমাত্যবর্গ নিয়ে সেখানে
উপস্থিত থাকবে।কুমার বভ্রুবাহন সবিনয়ে পিতা অর্জুনের আমন্ত্রন গ্রহন করলেন।কিন্তু
তার সঙ্গে বভ্রুবাহন এক প্রার্থনাও করলেন অর্জুনের কাছে।কুমার বভ্রুবাহন এখন পরিনত
আর একই সঙ্গে যথেষ্ট সংবেদনশীল। তিনি যথেষ্ট সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর
মাতা চিত্রাঙ্গদা আর বিমাতা উলূপী সুদীর্ঘ সময় স্বামীসুখ থেকে বঞ্চিত।চিত্রাঙ্গদা
তো তবু তিনটি বছর অর্জুনের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন; উলূপীর তো সেই সৌভাগ্যটুকুও কপালে
জোটেনি।অর্জুন তো তাঁর এক রাতের অতিথি। তাই তাঁর এই দুই মায়ের যন্ত্রনার কথা স্মরণ
করে বভ্রুবাহন অর্জুনকে অনুরোধ করে বললেন, আপনি অনুগ্রহ করে আপনার এই দুই ভার্যার
সঙ্গে আপনার এই পূরীতে প্রবেশ করুন।আপনি এই পূরীতে নিজগৃহে সুখে একরাত্রি বাস করে
আগামীকাল আবার যজ্ঞীয় অশ্বের অনুগমন করবেন।
অর্জুন
পরিনত মানুষ।তিনি বুঝতে পারলেন স্বামী বিরহে যন্ত্রনাকাতর মাতা চিত্রাঙ্গদা আর
বিমাতা উলূপীকে ক্ষনিকের জন্য হলেও স্বামীসুখে তৃপ্ত করতে চাইছেন কুমার
বভ্রুবাহন।বভ্রুবাহনের বক্তব্য আর উদ্দেশ্য বুঝেই অর্জুন বললেন , পুত্র তোমার এ
বিষয়ে আগ্রহ আর ভাবনা আমি বুঝতে পারছি।কিন্তু আমি এই যজ্ঞীয় অশ্বের অনুসরনব্রত গ্রহণ
করেছি। তাই তোমার পূরীর গৃহকোনে রাত্রিযাপন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।এই যজ্ঞীয়
অশ্ব ইচ্ছানুসারে বিচরন করে থাকে। এই অশ্ব যেখানে যাবে, আমাকেও সেই স্থানে যেতে
হবে; যেখানে থাকবে আমাকেও সেখানেই থাকতে হবে। তাই আমার উপায় নেই তোমার গৃহে
রাত্রিযাপন করবার। অর্জুন বিদায় নিয়েছেন যজ্ঞাশ্ব নিয়ে। কিন্তু আমন্ত্রন জানিয়ে
গেছেন উলূপী আর চিত্রাঙ্গদাকে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে থাকবার জন্য।
মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে আমন্ত্রনের বিশেষ প্রয়োজন ছিল অর্জুনের এই দুই
প্রবাসী স্ত্রীর, সামাজিক স্বীকৃতিলাভের জন্য; বিশেষত উলূপীর। অশ্বমেধ যজ্ঞ
উপলক্ষে এই দুই নারীর সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির পথ সুগম করেছেন মহাভারত রচনাকার।
সেটা যেমন কাব্যের প্রয়োজনে তেমনই মহাভারতের আপাত গৌন এই চরিত্রসমূহের পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্যও।
অর্জুনের
আমন্ত্রন রক্ষার্থে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে যোগদান করতে যথাসময়ে
অর্জুনের দুই প্রবাসী ভার্যা উলূপী ও চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত
হয়েছেন কুমার বভ্রুবাহন।হস্তিনাপুরে এসে বভ্রুবাহন জননী চিত্রাঙ্গদা আর বিমাতা
উলূপীকে নিয়ে প্রবেশ করলেন হস্তিনাপুরের অন্তঃপুরে।সভাগৃহে মান্যবর্গকে বিনম্র
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বভ্রুবাহন তাঁর দুই জননীকে নিয়ে প্রবেশ করলেন পিতামহী কুন্তীর
গৃহে। পৌত্র বভ্রুবাহনের সাথে পিতামহী কুন্তীর অনেক মধুর বাক্যালাপ হল।আর তারপর
অর্জুনের দুই প্রবাসী স্ত্রী সাক্ষাত করতে এলেন শাশুড়ী কুন্তী ও জ্যেষ্ঠা সপত্নী
পাণ্ডবপট্টমহিষী দ্রৌপদীর সকাশে।
অর্জুনের
স্ত্রীর পরিচয়ে এই প্রথম হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন উলূপী ও চিত্রাঙ্গদা। আর
অর্জুনের এই দুই প্রবাসী স্ত্রী রীতিমতো মর্যাদা ও সম্মান পেয়েছেন হস্তিনাপুরের
রাজপরিবারে। কুন্তী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা প্রচুর উপঢৌকন সহকারে তাঁদের বরন করেছেন
প্রায় নববধূর মতো।অর্জুনের অন্য দুই ভার্যা দ্রৌপদী ও সুভদ্রা দুজনের একজনও কিন্তু
উলূপী বা চিত্রাঙ্গদার প্রতি সামান্য ঈর্ষান্বিত হননি।বরং মহাকাব্যিক উদারতায় আপন
করে নিতে চেয়েছেন আদর আপ্যায়ন আর আতিথেয়তার মাধ্যমে।শুধু দ্রৌপদী সুভদ্রা নয়;
উলূপী আর চিত্রাঙ্গদাকে শ্বশুরবাড়ীতে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কুন্তীর ভূমিকাও
কম ছিল না। স্বচ্ছন্দে বসবাসের সুবিধার জন্য মহার্ঘ্য শয়নকক্ষযুক্ত পৃথক মহলেরও
ব্যবস্থা করলেন রাজমাতা কুন্তী অর্জুনের এই দুই বহিশ্চরা স্ত্রীর জন্য। কুন্তী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন উলূপী আর
চিত্রাঙ্গদার ওপর যথেষ্ট অবিচার হয়েছিল। স্বামীর বিরহযন্ত্রনায় চিরটাকাল দগ্ধ
হয়েছেন তাঁরা; বিশেষত নাগনন্দিনী উলূপী। আর হয়তো বা অপরাধবোধে কিছুটা ক্লিষ্ট
ছিলেন অর্জুনও। তাই অর্জুনের এই অপরাধবোধ প্রশমনের জন্য; তাঁর প্রীতি সম্পাদনের
জন্য ব্যবস্থাগ্রহনে উদ্যোগী হয়েছেন কুন্তী।
সমাপন
হয়েছে অশ্বমেধ যজ্ঞ।আমন্ত্রিত রাজা মহারাজারা ফিরে গিয়েছেন আপন আপন রাজ্যে। ফিরে
গিয়েছেন মনিপুর নরেশ বভ্রুবাহন।কিন্তু নিয়ে যাননি
তাঁর দুই মাতাকে –
চিত্রাঙ্গদা ও উলূপীকে। তাঁরা স্বেচ্ছায় থেকে গেছেন পাণ্ডব আবাসে।তার প্রমান আছে
মহাভারতেই। শোকসন্তপ্তা গান্ধারীর সেবা পরিচর্যার জন্য কুন্তী,দ্রৌপদী, সুভদ্রা
যেভাবে যত্ন নিচ্ছেন; ঠিক একই রকমভাবে তার দায়ভার
নিয়েছেন উলূপী ও চিত্রাঙ্গদা – “উলূপী
নাগকন্যা চ দেবী চিত্রাঙ্গদা তথা।”
এরপর
বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে।এ সময় সংসারের বন্ধনমুক্ত হয়ে বানপ্রস্থে গিয়েছেন
ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী আর পাণ্ডবজননী কুন্তী।পাণ্ডবরা কিন্তু তাঁদের কখনো ভুলতে
পারেননি। একটা সময় পাণ্ডবরা উতলা হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত করবার জন্য।
তাই সবার অনুরোধে যুধিষ্ঠির পাণ্ডবঘরের সমস্ত বউদের সঙ্গে নিয়ে সাক্ষাত করতে গেছেন
বানপ্রস্থব্রতী এই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সঙ্গে।
মহাভারতের
ঠিক এই সাক্ষাতের অংশটুকু কিন্তু উলূপীর ‘আইডেনটিটি’(Identity) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভীষণ
গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য পাণ্ডবজায়াদের সঙ্গে উলূপীও এসেছেন কুন্তীর সাথে সাক্ষাত
করতে। এসে দেখলেন কুন্তী, গান্ধারী আর ধৃতরাষ্ট্র বনবাসী তপস্বীদের সঙ্গে
ধর্মচিন্তায় কাল অতিবাহন করছেন।এই তপস্বীরা পাণ্ডবদের, তাঁদের ভার্যাদের সবার নাম
শুনেছেন কিন্তু আলাপ বা পরিচয় নেই কারো সাথে।তাঁরা যখন সবার পরিচয় জানতে চাইলেন
তখন সঞ্জয় একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন।দ্রৌপদীর যখন পরিচয় করানো হচ্ছে
তখন সঞ্জয় বলছেন – মাঝ
বয়স তাঁকে প্রায় ছুঁয়েছে। এরপর যখন উলূপীর কথা বলছেন সঞ্জয় তখন তিনি বলছেন, ওই যে
জাম্বুনদের সোনার মত যাঁর গায়ের রং তিনি অর্জুনের স্ত্রী কৌরব্যনাগের কন্যা উলূপী – “ইয়ঞ্চ জাম্বুনদশুদ্ধগৌরী পার্থস্য ভার্যা ভুজগেন্দ্রকন্যা”। দ্রৌপদীর যখন মাঝবয়স ছুঁয়েছে তখন নিশ্চয়ই উলূপীও মাঝবয়সী।খরস্রোতা নদী আজ মন্দাক্রান্তায়
উপনীতপ্রায়।কিন্তু মহাকবির বর্ণনা থেকে অতি সহজেই অনুমেয় এই মাঝবয়সেও উলূপী কতটা
সুন্দরী। যৌবনে তাঁর এই সৌন্দর্য্যই হয়তো পরোক্ষে শিথিল করে দিয়েছিল ফাল্গুনীর
ব্রহ্মচর্যের বন্ধন।কিন্তু মাঝবয়সে চেহারার এই সৌন্দর্য্যের থেকেও বড় বিষয় হল,
তপস্বীদের সকাশে তাঁর এই যে পরিচয় ‘পার্থস্য
ভার্যা’ – তা তাঁর ‘আইডেনটিটি’(Identity)প্রতিষ্ঠা করে পরিচয় মাহাত্ম্য দান
করেছে পূর্ণ মর্যাদায় –
পাণ্ডবকুলবধূ হিসাবে। উলূপী যিনি সারাজীবনে বলতে গেলে কিছুই পাননি তাঁর কাছে এই ‘আইডেনটিটি’(Identity)প্রতিষ্ঠাই জীবনে চরমতম প্রাপ্তি।
অর্জুনের বিবাহিত স্ত্রীর স্বীকৃতি। আজ প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে উলূপী স্থায়ী আসন লাভ
করেছেন স্বামীর আবাসে।পেয়েছেন তৃতীয়পাণ্ডবভার্যার মর্যাদা।
মহাভারতের
অন্তিমপর্বে মহাপ্রস্থানের পালা।দ্রৌপদীকে সাথে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যাত্রা করেছেন
মহাপ্রস্থানের পথে। পাণ্ডবদের অন্যান্য কুলবধূরা রয়ে
গেলেন হস্তিনাপুরেই। অভিমন্যুপুত্র কুমার পরীক্ষিতের পিতামহী সুভদ্রাও থাকলেন
হস্তিনাপুরে –
পরীক্ষিতের অভিভাবিকা হিসেবে। চিত্রাঙ্গদা ফিরে গেলেন মনিপুরে – পুত্র বভ্রুবাহনের কাছে।উলূপী কিন্তু কুরুবাড়ীর
অন্যান্য স্ত্রীদের মত হস্তিনাপুরেও থাকলেন না আবার পিত্রালয়েও ফিরলেন না। তিনি
ঝাঁপ দিলেন গঙ্গানদীবক্ষে – “বিবেশ
গঙ্গাং কৌরব্য উলূপী ভুজগাত্মজা ।” উলূপীর জীবনের অন্তিম পরিনতি হল গঙ্গাবক্ষে। আত্মবিসর্জন দিলেন উলূপী।যে
গঙ্গানদীবক্ষে প্রথম তিনি স্নানরত অবস্থায় দেখেছিলেন অর্জুনকে; আজ সেই গঙ্গায় ঝাঁপ
দিয়ে আত্মবিসর্জন দিলেন তিনি।অর্জুনকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছিলেন উলূপী।তাই
মহাপ্রস্থানের পথে যখন জীবনের অন্তিম পথের পথিক হয়েছেন অর্জুন তখন উলূপীও আর রাখতে
চাননি তাঁর এই পার্থিব শরীর। অর্জুন ছাড়া পৃথিবী আজ উলূপীর কাছে সম্পূর্ন অর্থহীন –তাই এই নিরর্থক জীবন রাখার থেকে আত্মবিসর্জনকেই
শ্রেয় মনে করেছেন উলূপী।
অর্জুনকে
প্রথম যেদিন দেখেছিলেন উলূপী সেদিন খুব বেশীমাত্রায় ছিল তাঁর শারীরিক আকাঙ্ক্ষা
সেটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয় কারন সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত নববিবাহিতা নারীকে সহসা
স্বামীহারা হতে হয়েছিল। তাই তাঁর অপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক চাহিদা যদি অর্জুনের মত
অসাধারন এক পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট করতে প্রণোদিত করে আসঙ্গলিপ্সায় উৎসুক করে তোলে
তবে তার মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।অর্জুন তো ছিলেন তাঁর এক
রাত্রির অতিথি।তারপর তো বহুবছর অর্জুনের সাথে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অথচ
অর্জুনকে মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হননি তিনি।যখন প্রথম অর্জুনকে দেখে আকৃষ্ট
হয়েছিলেন উলূপী তখন তার মধ্যে হয়ত তামসী
বা রাজসী ভালোবাসার এক লক্ষ্মন ছিল; কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অর্জুনের
মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় সে তামসিক ভালোবাসাও উন্নীত হয়েছিল সাত্ত্বিক ভালোবাসায়। এই যে ‘ট্রান্সফরমেশন অব লাভ’ (transformation of love) বা ভালোবাসার প্রকৃতির পরিবর্তন – উলূপীকে, উলূপীর ব্যক্তিত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে বিকশিত করেছে। উলূপী উন্নীত
হয়েছেন এক অনন্যসাধারন প্রেমিকার মর্যাদায়। আপন ব্যক্তিসত্তায় সম্পূর্ণ হয়েছেন
উলূপী।
অর্জুনের ভালোবাসায় এতটাই
নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন উলূপী যে তাঁর জন্য নিজের আত্মজকে পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন।যে
কোনো মা’র
কাছে তাঁর সন্তান সর্বাপেক্ষা প্রিয়।শাস্ত্র অনুসারে বলা হয় সন্তান জন্মায় আত্মা
থেকে।“আত্মা
হতে পুত্র জন্মে ব্যাসের বচন।” কুরুক্ষেত্রের ভয়ংকর মহাসমরে পুত্রের প্রাণের ঝুঁকি সত্ত্বেও ইরাবানকে
যুদ্ধে পাঠান উলূপী।যাতে কিনা এই মহাযুদ্ধে কিছুটা হলেও সহায়তা করা যায় অর্জুনকে।
যুদ্ধে প্রাণ হারান ইরাবান। সেজন্য কিন্তু কোনোরকম দোষারোপ বা পুত্রকে রক্ষা না
করতে পারার জন্য কোনোরকম অভিযোগ – কোনোটাই অর্জুনের কাছে করেননি উলূপী। এর
থেকে বড় আত্মত্যাগ আর কি হতে পারে? অথচ চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের কাছে অধিক প্রিয়,অধিক
ভালোবাসার পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বভ্রুবাহনকে
পাঠাননি।উলূপীর ভালোবাসা প্রকৃত অর্থেই ছিল সীমাছাড়া। এক অর্থে আত্মবলিদান করলেন
উলূপী –
অর্জুনের প্রেমে। এমনই তীব্র প্রেমের আকুতি ছিল উলূপীর।
এমন
অসাধারন স্বার্থত্যাগ,নারীর প্রেমের এমন তীব্রতার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। গ্রিক
অতিকথায় বর্ণিত অ্যাডমিটস-এর অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু নিবারিত হতে পারত শুধুমাত্র তার
বিনিময়ে অন্য কেউ মৃত্যুবরন করলে।কিন্তু কোনো আত্মীয় পরিজন, স্বজন বান্ধব কেউই
রাজি হয়নি; রাজি হয়েছিল শুধু তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী অ্যালকেস্টিস।এসব উপাখ্যানে প্রেমকে এক নতুন মাত্রায়, অনন্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে
প্রিয়জনের জন্য স্বার্থত্যাগ,আত্মত্যাগ।উলূপীরও অর্জুনের প্রতি ভালোবাস ছিল এতটাই
গভীর।অর্জুন বিনা তাঁর জীবন ছিল অর্থহীন।নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেও অর্জুনের ইহলোক
পরলোকের মঙ্গলকামনায় ভাবিত ছিলেন উলূপী। মহাভারত গবেষক ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য
যথার্থই বলেছিলেন, “ক্ষমতায়
উলূপী চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রার থেকে অধিক শক্তিশালিনী ছিলেন।ভীষ্মবধের পাপ থেকে তিনি
অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন।” উলূপীই অর্জুনের ব্রহ্মচর্যের
বন্ধন শিথিল করে চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রার প্রণয়ের পথ অসম্বাধ করেন।
প্রকৃতপ্রেমে
যেমন শ্রদ্ধা থাকে তেমনি সেখানে প্রিয়জনের প্রতি শারীরিক আকর্ষন থাকাটাও
যথেষ্টমাত্রায় স্বাভাবিক।যে প্রেম শরীরি আকর্ষনকে কেন্দ্র করে আরম্ভ হয়েও শরীরকে
অতিক্রম করে হৃদয়কে আশ্রয় করেছে আর তার মাধ্যমে যদি বিবাহ সংঘটিত হয় তবে সেই
প্রেম, সেই বিবাহ এক অন্য মাত্রায় উন্নীত হয়।উলূপীর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।
উলূপীও প্রথমে অর্জুনের প্রতি আকৃষ্ট
হয়েছিলেন শারীরিক আকর্ষনে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাঁর এই পার্থিব আকর্ষন
পর্যবসিত হয় সাত্ত্বিক ভালোবাসায়।উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে কৌরব্যনাগনন্দিনী
উলূপীর প্রেম। প্রেমের উত্তরনে ভাস্বর হয়ে ওঠে উলূপীর নারীসত্তা। উলূপীর প্রেম ছিল
সম্পূর্ণ নির্ভীক। যা মৃত্যুকেও ভয় পায় না।“There
is no fear in love, perfect love casteh out fear…he who fears has not been
perfected in love… love is as strong as death” I John 4:18; Song of Solomon 8:6 (প্রেমে ভয় নেই, পরিপূর্ণ প্রেম
ভয়কে সরিয়ে দেয়, ... যে ভয় পায় সে প্রেমে পরিপূর্ণতালাভ করেনি......প্রেম মৃত্যুর
মতই শক্তিশালী এবং অমোঘ।)। উলূপীর প্রেম প্রকৃত অর্থেই
পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। মৃত্যুকেও তা ভয় পায়নি।তাই উলূপী যখন দেখলেন মহাপ্রস্থানের
পথে চলেছেন ফাল্গুনী – যার
পরিনতি অবশ্যই মৃত্যু; তখন তিনিও আত্মবিসর্জন দিতে সামান্যতম কুন্ঠিত বা
দ্বিধান্বিত হননি। প্রেমিক ফাল্গুনী বিনা তাঁর জীবনধারন যে সম্পূর্ণ মূল্যহীন।
উলূপীর এই আত্মবিসর্জন তাই তাঁর প্রেমকে চির অমোঘ করেছে। প্রেমের গভীরতা যে কতটা
হতে পারে তার এক শাশ্বত উদাহরন, এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাস্তবে তো
বটেই যেকোনো সাহিত্যেও এমন তীব্র ভালোবাসার নিদর্শন পাওয়া দুষ্কর।
আপনারা
চিনলেন তো উলূপীকে। বুঝলেন তো উলূপীর প্রেমের গভীরতাকে। যাঁর কাছে প্রেমই ছিল
বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন। তাই প্রথম দর্শনেই অর্জুনকে বলেছিলেন, আমাকে গ্রহন
করে প্রাণরক্ষা কর আমার। আজ উলূপীর অন্তিম পরিনতি দেখে বোঝা যায় কতটা সুতীব্র,
কতটা সুগভীর প্রেমের আকুতি ছিল উলূপীর।
শুরু
করেছিলাম Shakespeare এর একটা কথা দিয়ে -
Frailty! Thy name is woman (ফ্রেইলটই! দাই নেম ইজ ওম্যান।)। কিন্তু কি মনে হয় আপনাদের – উলূপীর মতো নারীদেরও কি একই পঙতিতে রাখা যায় ?
নাকি উলূপী হলেন সেই নারীদের মধ্যে যাঁরা প্রেমের মধ্যেই মুক্তি খোঁজেন।
“আমার
প্রেম রবিকিরণ হেন।
জ্যোতির্ময় মুক্তি তোমাকে ঘিরে যেন।”
সমাপ্ত
..................০..................
valo laglo onek kisu jante parlam
ReplyDelete